সাহিত্যিক

পাঠককে শিল্পরস আস্বাদনের স্তর পূরণ করতে হয়

পিয়াস মজিদ – জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০। সাহিত্যের সকল বিষয়ে লিখলেও কবিতা লিখতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন বেশি। কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘ভুবনডাঙা’ এবং ‘আর্কেডিয়া’। পুরস্কার পেয়েছেন একাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার ২০১২ এবং সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার ২০১৬।

তিনি বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।

Pias Majid

একজন কবি কখন স্বকীয় হয়ে ওঠেন কিংবা অন্যভাবে বললে একজন কবির লেখায় কখন স্বকীয়তা দেখা যায়? যেমন আপনার লেখায় স্বকীয়তা আছে, আপনার একটা নিজস্ব ধারা তৈরি হয়েছে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলুন।

পিয়াস মজিদ: কবিতায় স্বকীয়তা একটি আপেক্ষিক বিষয়। কবির নিজের পক্ষেও উপলব্ধি করা কঠিন যে কখন তাঁর লেখা স্বকীয় হয়ে উঠছে। পৃথিবীর সব কবিই চায় তাঁর কথাটি তাঁর মতো করে বলতে। দেখা যায় মধ্যযুগের কবিরা কিংবা একদম প্রাকযুগের কবিরাও যেমন প্রেমের কথা বলেছেন, প্রকৃতির কথা বলেছেন, তেমনি সাম্প্রতিক কবিরাও ঠিক একই কথা বলছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সব কবিই কোনো না কোনোভাবে ধরাবাঁধা। মানবীয় অভিজ্ঞতার বাইরে তো আর কোনো কবিই যেতে পারেন না। এ জন্যে এ অভিজ্ঞতাগুলো সব কবির কাছেই সমান। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার কেলাসনটা কার কাছে কীভাবে ধরা দেয় এটিই তার স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করে।

শুধু কবি কেন, শিল্পমাধ্যমের যেকোনো জায়গায় ঐ স্বাতন্ত্র্য না থাকলে সে হয়তো খ্যাতি পেতে পারে, কিন্তু তার নিজস্বতা যত দিন তৈরি না হয়, তাঁর পক্ষে স্বকীয় হওয়া সম্ভব নয়। এটি উপলব্ধির বিষয়। অনেক পাঠক কিংবা সমালোচক হয়তো এটি সনাক্ত করতে পারবে, তখন তার ভেতরেও ওই বোধোদয় চলে আসবে যে, আমি কী লিখবো, কীভাবে লিখবো। একজন কবির তখন নিজের ধারা তৈরি হয়ে যায়। আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যেটা বলতে পারি, লেখালেখি শুরু করার পর ভাবি, আমি নতুন কিছু করবো। আমার কাছে তো পাঠক নতুন কিছু চাইযে যা এর আগ পর্য়ন্ত কবিতায় সে পায়নি। যেকোনো কবির কবিতাতেই পাঠক নতুনত্ব খুঁজবে। সেটা করার একটা প্রয়াস তো অবচেতন মনেই ছিলো। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন, ‘আপন মুদ্রাদোষে আমি হতেছি আলাদা’ তেমনি আপন স্বাতন্ত্র্যই কবিকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা করে।

জীবনানন্দের কবিতা পড়লে যেমন এক আলাদা জগতে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করে, তেমনি আপনার কবিতায়ও পাঠক এক ভিন্ন জগতের স্বাদ পায় যা জীবনানন্দ থেকে আলাদা। জীবনানন্দের কবিতাকে আপনি কীভাবে পাঠ করবেন এবং এই দুটো জগতের মাঝে কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করবেন?

পিয়াস মজিদ: এই তুলনাটি খুবই অসম তুলনা। জীবনানন্দের কবিতা বাংলা কবিতায় খুবই সংক্রামক এবং চ্যালেঞ্জিং প্রতিমা। তাঁর প্রতি পাঠকের মুগ্ধতা আছে। কিন্তু অন্য কবিদের জন্য দরকার সতর্কতা। তাঁর চোরা প্রভাব অতিক্রম করে নিজের মতো করে লেখা কবির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। বাংলা সাহিত্যের জন্য এটি অত্যন্ত গর্বের, গত শতকে একজন কবি এমনভাবে কবিতা লিখে গেছেন যে তার ভাষা কিংবা আঙ্গিক আজো আবিষ্কার হবার অপেক্ষায়। সে জায়গা থেকে এটি সম্পূর্ণই পাঠকের পাঠোদ্ধারের ব্যাপার যে তারা আমার কবিতায় একটি আলাদা জগতের স্বাদ পায় কিনা। আমি চেষ্টা করি আমার কবিতায় একটি আলাদা জগত তৈরি করতে। কারণ< চেনা জগতের ভেতরে থেকেই একটি কবিতা-জগত বা মানস-জগত তৈরি করা এবং সে জগতে ভ্রমণ করার চাবি যদি পাঠককে না দিতে পারি তবে কবিতা লেখা কেন! নতুনত্বের চেষ্টাটা আমার মাঝে সবসময়ই আছে। এখন পর্য়ন্ত (জানুয়ারি ২০১৫) আমার যে চারটি কবিতার বই, সেখানে এক জগত থেকে আরেক জগতে পাঠকের কক্ষান্তর যেন দৃশ্যমান হয় সে চেষ্টাটাই করেছি।

আপনার গোধূলীগুচ্ছ গ্রন্থে নিঃসঙ্গতা নিয়ে লিখেছেন। তো নিঃসঙ্গতা একজন কবি’র জন্য কতটা জরুরি এবং ব্যক্তিজীবনে তার প্রভাব কবিতায় কতটুকু পড়ে?

পিয়াস মজিদ: কতটা জরুরি এই কথায় আমার আপত্তি- কেননা বিষয়টা জরুরত দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আধুনিক মানুষ এমনিতেই নিঃষঙ্গ মানুষ। আধুনিক-উত্তর সময়ে যখন আমরা ফেসবুকের এক ক্লিকেই হাজার হাজার মানুষ পেয়ে যাচ্ছি সাইবার রিয়েলিটি জগতে তখনও কিন্তু নিঃসঙ্গতা কমছে না বরং বাড়ছেই। তো এই মানুষদেরই মধ্যে কবি বাস করেন, তিনি তো আলাদা কেউ নন। সুতরাং তার শিল্পে, কর্মে, বাক্যের বুননে এই নিঃসঙ্গ মানুষের ছায়া কিন্তু অবশ্যই পড়বে। যেমন, আমরা এখন সিলভিয়া প্লাথের লেখা কলোসল কাব্যগ্রন্থ বা উপন্যাস বেলজার-এর কথা বলতে পারি। বলা হয় যে প্লাথের ব্যক্তিজীবনের ছাপ আছে এসব বইয়ে। লেখক বা কবি’র ব্যক্তিজীবন আর শিল্প কি অদ্বৈত নাকি আলাদা এই বিতর্ক পুরোনো। সুতরাং এটা নিয়ে মীমাংসায় যাওয়া কিন্তু জরুরি না। একজন বিজ্ঞানী যেমন তার চিন্তা-ভাবনার জগৎ থেকেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন তেমনি একজন শিল্পীর শিল্পও ক্তিু তার চিন্তা-ভাবনা, বোধ-বিশ্বাসের উপস্থাপনাই হওয়ার কথা। তাই আমার কবিতায় আমার বাস্তব জীবনের ছায়া আছে কি-না, এ প্রসঙ্গে বলতে পারি- আমার বাস্তব জীবনের বাইরে তো আমার কবিতা বাস করে না। কিন্তু তাই বলে একজন ব্যক্তি কবিকে দেখেই তার কবিতার মাপকাঠি ঠিক করা যাবে না। বাহ্যত আমরা যা দেখি কবির চিন্তাচেতনা ওইরকম নাও হতে পারে।

অনেক পাঠক বলেন বর্তমানের কবিতা দুর্বোধ্য। আসলেই কি দুর্বোধ্য নাকি পাঠক হিসেবে এটা তার ব্যর্থতা?

পিয়াস মজিদ: আমি সব সময় মনে করি- শিল্পশিক্ষা অতি জরুরি বিষয়। একজন কবিকে যেমন অনেক কিছু জানতে হয়, তেমনি পাঠককেও কিন্তু শিল্পরস আস্বাদনের স্তর পূরণ করতে হয়। পাঠককে জ্ঞানী হতে হবে, তা নয়। কিন্তু তার ন্যূনতম শিল্পবোধ এবং শিল্পচৈতন্য থাকতে হবে। সময়ের সাথে ভাষার, চেতনার রঙের এবং শিল্পকাঠামোর যে পরিবর্তন সেটা পাঠক যদি বুঝতে না পারেন তাহলেতো শিল্পের রসাস্বাদনে সমস্যা হবেই।

বিশ্ব-সময়ের সাথে বাংলা আধুনিক কবিতার ভাষা ও আঙ্গিক পরিবর্তনটা আপনি কীভাবে দেখছেন?

পিয়াস মজিদ: দ্রুত পরিবর্তমান বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এখনও আমরা বিদেশি কবিতা বলতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট-ই বুঝছি, ওগুলোই অনুবাদ করছি। আমরা কিন্তু জানছি না ঠিক এই সময়ে যুগোস্লাভিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভূটান, সোমালিয়া, ইরাক কিংবা অন্যান্য দেশে ঠিক কেমন কবিতাচর্চা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গত কয়েক শতকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সেটা আমাদের দেশেও হয়েছে। নজরুল কিংবা সমসাময়িক কবিগণ যেভাবে কবিতা লিখেছেন আমরা শূন্য দশকের কবিরা কিন্তু সেভাবে লিখি না। এই পরিবর্তনমানতাকে বুঝতে হবে, শৈল্পিক অনুধাবনে রাখতে হবে।

বর্তমানের তরুণদের কবিতা পড়লে মনে হয় যেন সব একজনেরই লেখা। এ ব্যাপারে আপনার কী বলার আছে?

পিয়াস মজিদ: এটাতো চিরকালিন সংকট। তরুণরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্য়ন্ত প্রভাবযুক্ত কবিতা লিখে। কিন্তু একটা সময় গিয়ে তার ভাষার বাঁকবদল হয়। তখন সে তার স্বকীয়তা তৈরি করে নেয়।

একজন তরুণ যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তিনি কিন্তু তার অগ্রজদের অনুকরণ অনুসরণ করেই শুরু করেন ঠিক গাণিতিক হিসেব মেনেই যে, অগ্রজ যেহেতু এভাবে লিখে বিখ্যাত হয়েছেন আমিও সেভাবে লিখে বিখ্যাত হয়ে যাবো। এই সমস্যা থেকে কীভাবে বের হয়ে আসবে একজন তরুণ কবি?

পিয়াস মজিদ: অবচেতন বা সচেতন যেভাবেই হোক, প্রিয় কবি’র প্রভাব তার মধ্যে পড়তেই পারে। এটা একটা বিপজ্জনক-মোহিনী পথ। তবে তরুণ কবি যদি নিজের স্বকীয়তা (তার তরঙ্গ যতো ক্ষীণই হোক) যদি সাহসের সাথে ধরে রেখে এগোতে পারেন তাহলে আর তিনি এই সমস্যায় পড়বেন বলে আমার মনে হয় না।

সব কবিরই নিজস্ব কিছু শব্দ থাকে। আপনার কবিতা পড়লেও সেটা বুঝা যায়। যেটা পড়লে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, হুম, এটা অমুক কবির কবিতা।

পিয়াস মজিদ: ভাষা-শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো করতেই হবে কবিকে। অভ্যস্ত-জীর্ণ কবিতার বাইরে গিয়ে কিছু লিখতে না পারলে সেটা চূড়ান্ত বিচারে ভালো কোনো কবিতা হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ভাষাকাঠামো তৈরি করতে হবে মানবিক অভিজ্ঞতার ভেতরে থেকে। তবে সেটা যেন আরোপিত কিংবা উদ্ভট কিছু না হয় সেটাও ভাবনায় রাখতে হবে।

বর্তমান মিডিয়া প্রচণ্ড কবিতাবিমুখ। তারা শুধু গুটিকয় সহজ কবিতা; যেগুলো আবৃত্তি হয়; প্রমোট করছে। কিন্তু শিল্পীত অনেক কবিতাই যে চাপা থেকে যাচ্ছে সেদিকে তাদরে নজর নেই। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

পিয়াস মজিদ: হ্যাঁ, এটা দীর্ঘদিন যাবৎ হয়ে আসছে। অন্তমিলযুক্ত সহজবোধ্য কবিতাই আবৃত্তি হচ্ছে আর এগুলো পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বেশি। আমি মনে করি এতে করে প্রকৃত আধুনিক কবিতা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেখা যায়, একজন কবির অনেক শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা আছে কিন্তু আবৃত্তি হচ্ছে তার সহজবোধ্য কবিতাটি যা হয়তো শিল্পবিচারে উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। আমাদের অধিকাংশ আবৃত্তিকার এখনও বেশির ভাগ সময় পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। এখনকার কবিদের সাথে আবৃত্তিকারদের তেমন একটা যোগাযোগ কিন্তু নেই। এই দূরত্বটা কমাতে হবে।

কবিতা লিখতে গিয়ে একজন তরুণ প্রথমেই পরিবারের কাছে বাধার সম্মুখিন হন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

পিয়াস মজিদ: প্রতিটি শিল্পীর একটা একক সত্ত্বা থাকে যেখানে তার প্রিয়তম বা প্রিয়তমারও প্রবেশের অনুমতি নেই- শিল্পীর একান্ত আপন ভুবন। প্রকৃত কবিকে তার নিজস্ব ধরনে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই এই বিষয়ে বিধিবদ্ধ উত্তর দেয়া কঠিন।

আপনি কবিতা ছাড়াও গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখেন। তো দেখেছি যে, আপনার গল্পে আপনার কবিতার একটা প্রচ্ছন্ন ছাপ আছে। গদ্যগুলো পদ্যময়। কবি যখন গদ্য লেখেন তখন সেটা একটা আলাদা মাত্রা পায়। এই বিষয়টা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

পিয়াস মজিদ: আমরা এখন অখণ্ড শিল্পসময়ে বাস করছি। এই শিল্পসময়ে ভাষ্য বিভিন্ন হতে পারে। কবিতায় হতে পারে, উপন্যাসে হতে পারে এমনকি একটা বই-আলোচনাতেও হতে পারে। গদ্য লিখতে গিয়ে কবিতার শব্দমালা আমাকে লাবণ্য যোগায়। আমি চেষ্টা করি কবিতা-গদ্য সবকিছুর মধ্য দিয়ে অখণ্ড শিল্পভাষ্য প্রনয়ণের।

বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলুন।

পিয়াস মজিদ: চূড়ান্তস্পর্শী প্রযুক্তি-বিকাশের ফলে পৃথিবী এখন চরম ক্ষুদ্রীভবন হয়ে গেছে। এদিক থেকে বাংলা কবিতাও কিন্তু আলাদা বিষয় নয়। সময়টা দ্রুত বদলে যাচ্ছে, এই বদলে যাওয়া সময়ে ব্যক্তির আসন্ন বাংলা কবিতার ভবিষ্য-পথ নির্মাণ করবে।

——
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রাব্বী আহমেদ

ফেসবুক-এ লগিন থাকা অবস্থায় মন্তব্য করুন-

টি মন্তব্য

Facebook

Get the Facebook Likebox Slider Pro for WordPress