দৈনন্দিন কাজে কতটা বয়ে বেড়ান দাদুকে?
আসলে দাদুকে আমি ভুলে থাকতে পারি না। প্রতিনিয়ত তাঁকে বয়ে বেড়াই। দাদুকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন আমার!
এমন একজন মানুষ নিয়ে স্বপ্ন দেখা সত্যিই গর্বের। আচ্ছা, নজরুলের চুরুলিয়ার বাড়ির কী অবস্থা? যেই বাড়িতে তিনি জন্মেছিলেন; সেই বাড়িটা কি আছে এখনও?
না, সেটা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আমি কখনও দেখিনি সেই বাড়ি। সেখানে এখন আমার দূর সম্পর্কের চাচারা থাকেন। তবে বাড়ি ও গ্রামের তেমন কোনো উন্নয়ন করেননি! যদিও সরকার থেকে এজন্য তারা অনেক টাকা পান। আর দাদু যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ছবি দেখেছি। সেই ছবি সংরক্ষণও করেছি।

মুখোমুখি : কাজী অনির্বান এবং আশিক মুস্তাফা
নজরুলের বাড়িটাকে তো মিউজিয়ামও করা যেতো? নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে পারতো?
সমস্যা হচ্ছে, সেটা এমন জায়গায়, যেখানে সাধারণ মানুষের যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব।
শান্তি নিকেতন তো আরও দুর্গম ছিলো। সেখানো তো দিনে যেতেও মানুষ ভয় পেতো এক সময়। কিন্তু সেটা তো এখন মানুষের প্রাণের জায়গায় স্থাপিত হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে চুরুলিয়াকে কি মানুষের জন্য সহজগম্য করা যেতো না?
শান্তি নিকেতনের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই, সেই উদ্যোগ নিতে পারেননি দাদু। তিনি তো চলে এসেছিলেন জায়গাটা ছেড়ে। তবে দাদু যেহেতু সেখানে জন্মেছেন, সেক্ষেত্রে ইচ্ছে করলে সেখানে এখনও অনেক কিছু করা যায়। আসলে হয়েছে কি, সেখানে যারা থাকেন তারা চান না জায়গাটায় কিছু হোক। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, কলকাতায় নজরুল ইনস্টিটিউট গড়ে উঠছে কবি জয় গোস্বামী আর আমার মা ঐশ্বরিয়া কাজীর হাত ধরে।
এই ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম আর বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার অনুভুতি কেমন?
কলকাতা নজরুল ইনস্টিটিউট দাদুর জন্মদিন-মৃত্যুদিন এসব নামমাত্র অনুষ্ঠান করেন। সরকার থেকে একটা বাজেট থাকে, তাই করেন আর কি! আসলে এটা এখনও সংগঠিত হয়নি সেভাবে।
নজরুলের কোন দিকটা নিয়ে এখনও তেমন কাজ হয়নি বলে আপনি মনে করেন?
দাদুর সৃষ্টিকর্মে অনেক সংবেদনশীল দিক আছে, যেগুলো নিয়ে এখনও কাজ হয়নি। যেমন : মানুষের চেতনাবোধ, ইকুয়ালিটি, নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে দাদু যা বলেছেন, তা নিয়ে এখনও তেমন কাজ হয়নি। আসলে খাতা কলমে আমরা অনেক কিছুই বলি। কিন্তু বাস্তবে তা করি না।
আসলে এ অবস্থার পরিবর্তন এবং এইসব কাজ বাস্তবায়ন করা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়; সেজন্য পুরো সমাজটাকেই বদলাতে হবে। এটা যতোদিন পরিবর্তন হবে না, ততোদিন ধর্ষণের মতো অপরাধও কমবে না। তবে এখানেও মনে হয় যে, কলকাতার চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ অনেক সচেতন ও প্রগ্রেসিভ। আপনি কী মনে করেন?
তা অবশ্যই ঠিক। আমি বাংলাদেশে যাদের সঙ্গে মিশি, যাদের বাড়ি যাই, তারা তো অনেক আগানো। তবে কলকাতা এমন হওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে মিক্সড কালচার। নানা কালচারের মিশ্রণে কলকাতা এভাবে গড়ে উঠেছে।
নজরুলকে নিয়ে দেশের বাইরে রিসার্চ হচ্ছে কেমন?
কিছুদিন আগে দাদুকে নিয়ে রিসার্চ করতে আমেরিকা থেকে একজন প্রফেসর এসেছিলেন। তিনি একজন আমেরিকান মহিলা। দাদুর শ্যামা সঙ্গীতও অনুবাদ করেছেন সেই ভদ্র মহিলা। তিনি আট মাস কাজ করবেন দাদুর উপর। বাংলাদেশে থাকবেন ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। আমি ওনাকে অনেক তথ্য দিয়েছি, বই দিয়েছি- যে তথ্যগুলো তিনি আগে বাংলাদেশে বহুবার গিয়েও পাননি।
এটা কি সেই কলম্বিয়ান প্রফেসরের কথা?
হ্যাঁ।
নজরুলের সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত এবং তাঁর সার্বিক জীবন নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পাশাপাশি তাঁর স্মৃতি সংশ্লিষ্ট নিদের্শনাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্যই বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে। তাতে তো গবেষণার জন্য অনেক তথ্য-উপাত্য রয়েছে। এসবের পাশাপাশি আপনার কাছ থেকে যে তথ্য তিনি নিয়েছেন, সেই তথ্যগুলোও আপনি নজরুল ইনস্টিটিউটকে দিয়ে দিতে পারেন। এতে আরও যারা গবেষণা করতে চান, তারাও উপকৃত হবেন।
আমিও চাই সেসব তথ্য-উপাত্য দিতে। আসলে দাদুই চেয়েছিলেন তার কাজ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়–ক।
এমন কী আছে আপনার কাছে?
অনেক দুর্লভ ছবি- যার কিছু ছবি বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউট আমার একটা বই থেকে স্ক্যান করে নিয়েছে। দাদুকে নিয়ে নানান তথ্যের বই, গানের বই আছে। সবাই জানেন, দাদু কালী পূজো করতেন, আবার নামাজও পড়তেন। দাদুর জায়নামাজ আছে। কোরআন শরীফও আছে। সেই কোরআন শরীফের অনুবাদের কারেকশানও করেছিলেন দাদু। এই কোরআন শরীফ কেন যেন হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না আমার। সেটা জাদুঘরের জন্য নিতে বাংলাদেশ থেকে একবার একরামুল হক এসেছিলেন। ওনাকে বলেছিলাম, আমি মারা গেলে সেটা আমার ছেলের কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের কিছু রেকর্ড আছে ড. রবীন্দ্রনাথ ট্যাগুর নামে। সে সব দেখে তো ওনার মাথা খারাপ হয়ে যায়!
কলকাতার পথে ঘাটে মেট্রোতে চলতি পথে কান পাতলেই রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা যায়; কিন্তু নজরুল সঙ্গীত সেভাবে কানে আসে না। এর কি সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?
রবীন্দ্রনাথের দেড়শতম জন্মজয়ন্তি উপলক্ষ্যে রাস্তার মোড়ে তার গান বাজানোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। তবে এতে অনেকে বিরক্তও হচ্ছেন। রাস্তার মোড়ের পাশে যাদের বাড়ি, তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে না- এমন অভিযোগও জানিয়েছেন অনেকে। তবে আমি বলি কি, গানই তো!
রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে, তা সমস্যা নয়। এটা ভালো। নজরুলও তো গান লিখেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেমন গান লিখেছেন, তেমনি শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তনও লিখেছেন। এইচএমভির দুর্লভ রেকর্ডে ৫৭টি শ্যামা সঙ্গীতের মধ্যে নজরুলেরই ছিল ১৩টি। তবু কলকাতায় পথে-ঘাটে সেভাবে নজরুলের গান শোনা যায় না কেন? এর কি কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে? বা এতে কি নজরুল অবহেলার শিকার হচ্ছেন?
হতে পারে। আসলে মানুষের চেতনার ভেতর থেকেই নজরুল বারবার ফিরে আসবেন। কে অবহেলা করলো, কে এড়িয়ে গেলো- তাতে কিছুই যায় আসে না। দাদু যা বলে গেছেন, যা লিখে গেছেন, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। তিনি নারী-পুরুষের সম্পর্কের কথা যা বলেছেন, তা আর কেউই বলেননি। ধর্ম নিয়ে যেই ভন্ডামির বিরুদ্ধে দাদু যেসব কথা বলে গেছেন, তা তো এখনও সমাজে চোখ বুলালে দেখতে পাই। আবার নিজ ধর্ম ছাড়াও তিনি অন্য ধর্ম নিয়ে লিখে গেছেন। আর এই জন্যই হয়তো দাদুকে রবীন্দ্রনাথ অনেক ভালোবাসতেন।
রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসাটা কি শুধুই অন্য ধর্ম নিয়ে লেখার কারণে পেয়েছিলেন নজরুল?
না; দাদুকে ভালোবাসার যথার্থ কারণ এটা নাও হতে পারে। আবার এটাও যে না- তা কে বলবে!
আপনার দাদুর গ্রহণযোগ্যতাটা কোথায় বেশি- পশ্চিমবঙ্গে না বাংলাদেশে?
অবশ্যই বাংলাদেশে। জীবিতকালে সেখানে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হতো দাদুকে। এখনও দেওয়া হয়।
ওনাকে নিয়ে বাংলাদেশে কেমন কাজ করছেন আপনার চাচাতো বোন খিলখিল কাজী?
আসলে চাচার পরিবার যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তাতে কাজ কতোটা হচ্ছে- তা আমি বলতে পারবো না।
তারা কাজের সম্মানী পাচ্ছেন, রয়ালিটি পাচ্ছেন, তাছাড়া রাষ্ট্রীয় আরও অনেক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। সে সবের কি অ্যাবিউস করছেন?
অ্যাবিউস না মিসইউস- তা বলতে পারবো না। তবে তারা সচেতন হলে দাদুকে নিয়ে আরও অনেক কিছইু করতে পারতেন। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফ্যাসিলিটি চাই না; সরকারও দেয় না। তবু আমার মা বলেন, দুই বাংলা মিলে কাজ করলে দাদুকে নিয়ে অনেক ভালো কাজ হতো।
নজরুল তো গান লিখেছেন অনেক। ১৯৩৭ সালের শুরুর দিকে কবি তার বন্ধু মুজাফফর আহমদের সঙ্গে কলকাতায় খেতে বসে বলেছিলেন যে, তার গানের সংখ্যা তিন হাজার। কথাটা শুনে মুজাফফর আহমদ আশ্চর্য হয়ে কবিকে বলেছিলেন, ‘বলছ কি? তোমার গানের সংখ্যা তো রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশী?’ নজরুল বলেছিলেন, হ্যাঁ, তার চেয়েও বেশি। তারও পরে মুজাফফর আহমদ লিখেছিলেন, ‘১৯৬৪ সালে শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর পত্রে আমি জেনেছি যে, কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গানের সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছেছে।’ তাছাড়া নজরুলের অসংখ্য গান তার জীবদ্দশায় চুরি হয়ে গেছে এবং হারিয়েও গেছে। আপনি জানেন সেটা?
হ্যাঁ; এটা আমিও শুনেছি। তাছাড়া নামে-বেনামে দাদুর গানের লাইন হুবহু নকলও করেছে অনেকেই। কিন্তু এ সবের দিকে নজর দেননি তিনি। কেউ দাদুকে জানালে তিনি হেসে উঠে বলতেন, ‘ধুর পাগল, মহাসমুদ্র থেকে ক’ঘটি পানি নিলে কি সাগর ফুরিয়ে যাবে? তাছাড়া নবাগতের দল এক-আধটু না নিলে পানি পাবেই বা কী করে?’
কিছুদিন আগে অমর্ত্য সেন তার এক সাক্ষাৎকারেও বলেছেন দাদুর গানের কথা। তিনি দাদুকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেই সাক্ষাৎকারে।
ঢাকায় আপনার দাদুর কবরে গিয়েছিলেন কখনও?
হ্যাঁ; গিয়েছি।
কেমন লাগলো?
খুবই ভালো লেগেছে। তবে দাদুর মাজারে গ্যালারির মতো যে জায়গাটা আছে, সেখানে দাদুর জীবনী নিয়ে যদি কিছু বোর্ড লাগানো যেতো তবে আরও ভালো লাগতো। যেমন, দাদু কোথায় জন্মেছেন, কোথায় বেড়ে উঠেছেন- এমন আরকি! তাছাড়া সিরিজ টাইপেরও করা যায়। এতে নতুন যারা আসবেন দাদুর মাজারে, তারা দাদু সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পাবেন। এই কথাটা আমি সেখানকার ভিজিটার্স বুকেও লিখে এসেছি। মজার ব্যাপার কি জানেন, একবার সেখানকার কেয়ারটেকারের কাছে জানতে পারি, দাদুর মাজারে অনেকেই আসেন নিজের জন্য কিছু চাইতে। মানে, মানুষ তাদের মনের বাসনাগুলো দাদুর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন। এক লোক সম্মান চেয়ে নাকি সম্মান পেয়েছেনও! এমন অনেক লোককে চেনেনও সেই কেয়ারটেকার- যারা দাদুর কবরে এসে এটা সেটা চেয়ে পেয়েছেন। তার এই গল্প শুনে কী যে ভালো লেগেছে আমার; তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না!
তবে কী আপনি এটাকে মাজারের সঙ্গে তুলনা করছেন?
না, না। আমি মানুষের বিশ্বাসের এবং দাদুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধাটা দেখে অবাক হয়েছি।
আপনি কিছু চেয়েছিলেন?
চাইনি; তবে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দাদুকে কথা দিয়েছি, তার কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবো।
নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। দেশের সবাই চান, তিনি যা বলেছেন, যা লিখেছেন- তা সবার কাছে পৌঁছে যাক। এই প্রতিজ্ঞার জন্য একজন বাংলাদেশি হিসেবে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
নজরুল ভক্ত-পাঠকদেরও ধন্যবাদ।
——————-
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আশিক মুস্তাফা
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন
ektee durdantho interview. onek kichu jana gelo.ojana onek kotha beriye elo. dhonnobad prio ashik mustafa.