সাহিত্যিক

আমার প্রথম বই কবিতার ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ – আনিসুল হক

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনার জন্ম ৪ মার্চ ১৯৬৫, নীলফামারিতে, এটা কি সার্টিফিকেট ইনফরমেশন? কোনো কোনো জায়গায় ৩ মার্চও দেখা যায়।
আনিসুল হক: আমার জন্মতারিখ আসলে তিনটা। একটা ১ জানুয়ারি, এটা সার্টিফিকেট এবং পাসপোর্টে আছে; একটা ৩ মার্চ এবং আরেকটা ৪ মার্চ, এই দুটো বইয়ের পেছনে আছে। পহেলা জানুয়ারিটা ভর্তির সময় থেকে বাবা-মা দিয়ে রেখেছেন, হয়ত হিসাবের সুবিধার্থে, এছাড়া অন্য কোনো কারণ দেখি না। আমাদের প্রায় সব ভাই-বোনেরই জন্মতারিখ ১ জানুয়ারি দেয়া আছে। আমার আসল জন্মতারিখ কবে সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করিনি অনেকদিন। আমি যখন বুয়েটে পড়ি, তখন একদিন আমাদের রংপুরের বাসায় পুরোনো ট্রাংক খুলে একটা ডাইরি পাওয়া গেল। সেখানে লেখা ছিল যে, আনিসুল হকের জন্ম ৪ মার্চ ১৯৬৫। এটা দেখে রংপুর থেকে ছুটি শেষে আবার ঢাকায় আসি, তারপর মার্চ আসে, আমি সিদ্ধান্ত নেই যে আমি আমার বন্ধুদেরকে খাওয়াব। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, আমি সংখ্যা বা নাম্বার মনে রাখতে পারি না। ৪ মার্চ সেটা দেখে এসেছি ঠিকই কিন্তু ঢাকায় আসতে আসতে সেটা ভুলে গেছি, আমার মনে হচ্ছে তারিখটা ৩ মার্চ, তাই ৩ মার্চ জন্মদিন পালন করি। বইয়ের পেছনে লিখি ৩ মার্চ। আর সংখ্যাতত্ত্ব হিসেবে দেখা যায়, আমার জন্ম মার্চ মাসে, মার্চ ৩ নম্বর মাস। আমি একটা তিনের জাতক, এই ভেবেই আমি বহুদিন চলাফেরা করেছি। এরপর আবার যখন বাড়ি যাই তখন দেখি, আব্বার নিজের হাতে লেখা এটা ৪ মার্চ। এখন, এই ভুলটা আমি বহন করে চলতে পারতাম, কিন্তু এটা সংশোধন করে ৪ মার্চে নিয়ে গেছি। ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে যে, আমার যে সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাস ছিল বা আমি ভাবতাম, ৩ আমার জন্য বিশেষ সংখ্যা এবং দেখতাম যে ৩ অনেকাংশে মিলে যায়, সেটা যে ভুয়া তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। আমার জন্ম হয়েছে নীলফামারিতে, এটা তখন রংপুর জেলার অন্তর্গত ছিল। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে আমরা রংপুর শহরে চলে আসি। আব্বা বদলি হয়ে চলে আসেন।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনার ছেলেবেলা এবং এখনকার ছেলেবেলার মধ্যে কোন পার্থক্যটা চোখে পড়ে?
আনিসুল হক: আমার মনে হয়, আমাদের সময়ে বাবা-মার সন্তানের সংখ্যা বেশি থাকতো। আমরা অনেক স্বাধীন জীবনযাপন করেছি, তবে হয়তো নিরাপত্তার বোধও ছিল। আমি যে বন্যার জলে নৌকা নিয়ে গেছি সেই নৌকা ডুবে গিয়েছিল, আমি সাঁতরে উঠেছি। আমি গরুর গাড়ি করে ধান আনতে গিয়ে ব্রিজের নিচে পড়ে গিয়েছি, আমি সেই ধানের বস্তার নিচে চাপা পড়তে পারতাম। আমি গাছের মগডালে অনেক উঁচুতে উঠে আর নামতে পারছিলাম না, কিভাবে যে বুকে বেয়ে বেয়ে নিঃসঙ্গ উঁচু একটা শাখা পার হয়েছি সেটা শুধু আমি জানি। সে কথা মনে করলে এখনও আমার ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে যে আমি মারা যেতে পারতাম। কিন্তু এগুলি করার ব্যাপারে আমাদের বাবা-মারা অনুমতি দিয়েছেন। আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এই স্বাধীনতার সুফলটা কী হলো, আমি যখন ঢাকা শহরে এলাম, এসে তো আমার কোনো মামা, চাচা, ভাই লেখালেখির জগতে আমাকে নিয়ে আসেনি। আমি নিজে নিজে এসেছি। আমি আজকে প্রথম আলোতে যে কাজ করি, আমার বাবা, চাচা বা মামা সম্পাদককে ফোন করে বলে দেয়নি যে আনিস যাচ্ছে, তাকে একটা জায়গা করে দেন। আমার লেখা যে ছাপা হয়েছে, কেউ কোন ফোন করে বলে নাই যে, ওর লেখা ছাপো। টেলিভিশনে আমার যে নাটক প্রচারিত হয়েছে কেউ ফোন দিয়ে অনুরোধ করে বলে দেয়নি, আনিসের নাটকটা প্রচার করে দাও। আজকে আমার নাটক যে কোনো চ্যানেলে প্রচার হয়। আমি যদি একটা চ্যানেলে যাই সেখানকার কর্মকর্তারা আমাকে দেখলে এক কাপ চা খাওয়াবেন। এই ভালোবাসাটা আমি পাচ্ছি, এটা কিন্তু আমি আমার নিজের যোগ্যতায় নিজের সংগ্রাম দিয়ে অর্জন করেছি। কিন্তু আজকের যে ছেলেটা, আমার মেয়েটা ওদেরকে আমরা সব জায়গায় আঙ্গুল ধরে নিয়ে যাই। ওদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিতে হয়, স্কুল থেকে কেউ না কেউ ওদেরকে গিয়ে নিয়ে আসছে। ও তো সংগ্রাম কাকে বলে বুঝছে না। ফলে যখন আমরা থাকবো না, পৃথিবীতে ওরা একা থাকবে, তখন ওরা কী করবে? সেটা আমরা কাছে খুব চিন্তার বিষয় মনে হয়।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনার প্রথম লেখালেখির গল্প সম্পর্কে বলুন।
আনিসুল হক: আমার প্রথম লেখা ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে যখন আমি ইন্টারমেডিয়েট পড়ি। অনিক রেজা নামে একটা ছেলে, সে পরে আর্ট কলেজে পড়াশুনা করে, রংপুরে আছে। ও একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করবে। সে বলল, আমাকে একটা কবিতা দেন। আমি বললাম, কবিতা মানে কি বড়দের কবিতা না ছোটদের কবিতা? সে বলল বড়দের কবিতা। মিলটিল দিয়ে ছড়া লিখলে চলবে না। তখনও আমি কচি-কাঁচার মেলা করি, বাচ্চাদের জন্য পদ্য লিখি, কিন্তু কবিতা বলতে আসলে কী বোঝায় সেসব ভাবছি এবং রবীন্দ্রাথের ক্যামেলিয়া, বাঁশি ইত্যাদি গদ্য কবিতাগুলো পড়ছি, ভাবছি, ছন্দ ছাড়া কীভাবে কবিতা হয়। তখন পড়া শুরু করলাম শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা; এর আগে সুকান্ত পর্যন্ত মুগ্ধ ছিলাম। কিন্তু কবিতার যে একটা নতুন ধরন সেই জগতই তো খুলতে শুরু করল। ও যখন চাইল, আমি দুটো কবিতা লিখে ওকে দিলাম। ফলে প্রথম লেখা ছিল কবিতাই। সে যে আমাকে কবিতার মধ্যে ঠেলে দিল এরপর থেকে আমি ক্রমাগত কবিতা পড়ছি এবং বোঝার চেষ্টা করছি কেন গদ্যে লেখা সত্ত্বেও একটা কবিতা হয় আরেকটা গদ্য হয়। ঐটা আবিষ্কারের নেশা থেকে আমি ক্রমাগত লিখে গেছি। এখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: প্রথম লেখার প্রেরণাটা কীভাবে পেলেন?
আনিসুল হক: আমি একদম ছোটবেলা থেকেই লিখি। প্রথম লেখা লিখেছি ক্লাস ওয়ানে। ছোটবেলায় রংপুরে আমরা শ্লোক বলতাম। আসলে ধাঁধাকে শ্লোক বলতাম। যেমন- তিন অক্ষরে নাম যার জলে বাস করে, মধ্যের অক্ষর কেটে দিলে আকাশেতে ওড়ে। এগুলো আমি ছোটবেলায় বানানোর চেষ্টা করেছি। অন্ত্যমিল দেয়ার চেষ্টা করেছি। এরপর স্কুলে যখন ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান হতো আমি নিজের লেখা কবিতা পড়ে শোনাতাম।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: বড় হয়ে লেখক হবেন এমন স্বপ্ন কি তখন কাজ করত?
আনিসুল হক: বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আমি ঘোষণা দিলাম যে, আমাকে কবি হতে হবে। এ জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত আছি। আমার একটা বন্ধু ছিল ফার্স্টইয়ারে, শহীদ স্মৃতি হলে আমার সাথে থাকত, শাহিন। সেও বলেছিল, তাকে কবি হতে হবে এবং ফার্স্টক্লাস পেতে হবে। প্রথম শ্রেণীর প্রকৌশলী হতে হবে। পরে সে অবশ্য মারা গেছে। ফলে আমার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল। ফার্স্টক্লাস পেলাম না। আমার আব্বার মৃত্যু একটা কারণ, পরীক্ষার মাঝখানে আব্বা মারা গেলেন। পরে ভালো প্রকৌশলী হবার ট্র্যাকটা আর ধরতে পারিনি। আমার ক্লাসের মেয়েরা বলল, তুমি যে পড়ালেখা করছ না, তুমি কী করবে? তখন বলেছিলাম, আমি সংবাদপত্রে কাজ নেব এবং লেখালেখি করব।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ছেলেবেলায় কোন লেখকের লেখা আপনাকে মুগ্ধ করত?
আনিসুল হক: তখন লেখকদের নামের দিকে দেখতাম না। গল্পটা পড়তাম। বড় হয়ে দেখি যে শিবরামের গল্প আমি পড়েছি। লেখকের নাম পড়তাম না, কিন্তু গল্পটা পড়েছি। ছোটবেলায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ ইত্যাদি কবিতাগুলি আমি খুবই পছন্দ করতাম। পিটিআইয়ের কোনো কোনো ব্যাচেলর টিচারদের রুমে বই পেতাম। ফররুখ আহমদ, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়েছি। খুব ছোটবেলায় রূপকথার গল্প পছন্দ করতাম। একটু বড় হয়ে ছোটগল্প পছন্দ করেছি, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্প আমি স্কুলে থাকতে পড়েছি। গল্প যেহেতু ৫-৭ পৃষ্ঠায় শেষ হয়, ফলে পড়ে ভালো বোধ করতাম।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনি হয়তো অসংখ্যবার এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন, তবু আর একবার, পাঠকদের জন্যে, আপনার প্রথম বই সম্পর্কে জানতে চাই।
আনিসুল হক: আমার প্রথম বই কবিতার- খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে। এটি বেরিয়েছিল ১৯৮৯ সালে। আমি তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় ৪র্থ বর্ষে পড়ি। কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল ১৯৮৩-৮৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত। সেই হিসেবে আমার নিজের বয়স ১৮/১৯ থেকে শুরু করে ২৩/২৪ বছরের একজন কিশোর তরুণ যা লিখতে পারে, তা এখানে ছিল। আবেগ ছিল। ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ এই নামটি শুনলেই বোঝা যায় যে, একটা লক্ষ্য থেকে এটা লেখা। যদিও কয়েকজন সমালোচক-কবি কবিতাগুলো পছন্দই করেছিলেন। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি আমার গদ্যকার্টুন বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে, আনিসুল হক যখন নিষ্পাপ ছিল তখন সে খোলা চিঠি লিখেছিল সুন্দরের কাছে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা- আমি জানতাম না যে, ‘দিকচিহ্ন’ নামে একটি কবিতার কাগজে তাঁর লেখা আলোচনা ছাপা হয়েছে বইটির। আমাকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন আর কি।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমি যদি কবি হই তাহলে জনতার দ্বারা অভিষিক্ত হব না, বাসের ভিড়ের ভেতর আমার জন্য কেউ আসন ছেড়ে দেবে না- এটা আমি জানি। তারপরও আমি চাই, যদি দু’জনও সমঝদার লোক থাকেন, তবে তাদের কাছে আমি যেন কবি হিসেবেই গ্রাহ্য হই…
আনিসুল হক: এই কথা থেকে আমি সরে আসছি না। আমি মনে করি, কবিতা লিখে আপনি উপন্যাসিকের মতো খ্যাতি পাবেন না, গুরুত্ব পাবেন না। কবিতা লিখে গায়ক বা ফিল্মস্টারদের মতো বা খেলোয়াড়দের মতো সেলিব্রিটি তো হবেনই না, প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যেটি হয়, যেমন জীবনানন্দ দাশ- তার জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি উপেক্ষিত ছিলেন। এমনকি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো বড় কবি, তখন যাকে কলকাতা শহরে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হতো, তিনি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর বলেছিলেন, যিনি কবি নন তার উপর একটা স্মরণিকা বের করার দরকার কী? মানে জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন, বুদ্ধদেব বসু একটা সংকলন বের করবেন, সেটার জন্য লেখা চাইতে গিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে। সুধীন তখন এ কথা বলেছিলেন। এমন ভুল বোঝাবুঝি হয়েই থাকে। কিন্তু একজন বুদ্ধদেব বসু ঠিকই টের পেয়েছিলেন যে জীবনানন্দ দাশ বড় কবি। জীবনানন্দ দাশের কিছু তরুণ ভক্ত তৈরি হয়েছিল, তারা বুঝতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ দাশ অনেক বড় কবি। যতই দিন যাচ্ছে তিনি বড় কবি হয়ে উঠছেন। ফলে কবি হলে নিঃসঙ্গ হতে হবে, তাকে কষ্ট পেতে হবে, এ কথা জানার পরেও যিনি কবি তিনি একজন পাঠক বা ভবিষ্যতে কোনো একদিন কোনো একজন পাঠক তাকে বুঝবেন, এই আশা থেকে তিনি লিখে যাবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও আপনার এমন আকাঙ্খাই প্রতিভাত হয়েছে যে, লোকে মানুক বা না মানুক আপনি এই পরিচয়টা মানুষকে দিতে চান।
আনিসুল হক: হ্যাঁ, এটা আমি দিতে চাই। এখন মানুষ নেবে কিনা দেবে কিনা এটা বলা খুব মুশকিল। কবিতা সমকালে বোঝা নাও যেতে পারে। অনেক সময় সমকাল কাউকে গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে মনে করে। পরে দেখা যায়, তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর বা কয়েক দশক পর দেখা যায় যে তাকে লোকে ভুলে যায়। এটা শিল্প-সাহিত্যের যে কোনো মাধ্যমেই হতে পারে। যাইহোক, একটা কবিতা আছে- আমি হয়ত মিশিয়ে ফেলছি, নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে আর নিকানোর পাররার নামে আরেকজন কবির কবিতা আছে : আপনি তো কবি, সাক্ষাৎকারের মতো কবিতাটা; কবি বলছেন, আমি যখন কবিতা লিখেছিলাম তখন আমি কবি ছিলাম। এখন এই মুহূর্তে তো আমি লিখছি না, এখন আমি কবি না। এটাও কিন্তু সত্য। কবি তখনই কবি যখন তিনি কবিতাটা লেখেন। এ কারণেই আমি বলছি, তারা লম্বা চুল রাখেন, পাঞ্জাবি পরেন, তারা কিন্তু নিজেকে সার্বক্ষণিক কবি ভাবেন। সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: একটি কবিতা বা গল্প এক বা একাধিক পত্রিকায় প্রকাশের ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আনিসুল হক: আমার ক্ষেত্রে কখনো কখনো এটা ঘটেছে। কাজেই এটাকে খুব খারাপ বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। অনেকের ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে। আমি যেটা সংবাদপত্রে, প্রথম আলোতে লিখি সেটা অন্য কোনো দৈনিক পত্রিকায় দেই না। কিন্তু কেউ এসে যখন কোনো স্মরণিকা বা স্কুল ম্যাগাজিনে, একটা লেখা চায়, তখন বলি যে আমার প্রকাশিত বই থেকে তোমরা যে কোনো একটা লেখা নিয়ে নাও। এমন করেছি। তবে না করা ভালো।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনার একটি কবিতা ‘কিছুই বলা হলো না’ প্রথম পড়েছিলাম প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ, এরপর ঐ লেখাটি লিটল ম্যাগাজিন সবুজ অঙ্গনে ‘আত্মকথা’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে।
আনিসুল হক: কিছুই তো বলা হলো না। হ্যাঁ, হয়েছিল। কিন্তু এটা প্রথম আলোতে হয়েছিল, মনে নেই। অনেক ক্ষেত্রে আমি ভুলে যাই, সব কম্পিউটারে থাকে তো।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: নির্মলেন্দু গুণ আপনার প্রিয় কবি। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক? আপনি তাঁর কথা প্রায়ই বলেন…
আনিসুল হক: আমার প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং নির্মলেন্দু গুণকে সাহিত্য সমালোচকরা বিচার করতে ভুল করছেন বলে আমার মনে হয়। অনেকে মনে করতে পারে যে তিনি তরল বা জনপ্রিয় কবি। কিন্তু আসলে গভীর, উপলব্ধিময়, জীবনের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ যেসব কবিতা তাঁর আছে, সেসব একা একা পড়লে মনে হয় হৃদয়টা শুশ্রূষা পাচ্ছে। আর সৈয়দ শামসুল হককে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও কবি মনে করি। তাঁর বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, পরানের গহীন ভিতর কাব্যগ্রন্থগুলি খুবই ভালো।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: নির্মলেন্দু গুণের কিছু কবিতার উল্লেখ করবেন যেগুলি আপনার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ?
আনিসুল হক: অনেক কবিতা আছে, দুঃখ করো না বাঁচো, নেই কেন সেই পাখি। প্রথমদিকের অনেক কবিতা ভালো।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনি তো কিছু গানও লিখেছেন। যেমন : আমার বয়স হলো সাতাশ/আমার সঙ্গে মিতা পাতাস/আমি মেঘের ছোট ছেলে…। সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
আনিসুল হক: এটা আমার কবিতার বই থেকে নিয়ে সঞ্জীবদা গান করেছেন। গীতিকার হিসেবে আমি চেষ্টা করিনি বললেই চলে। যেমন অর্ণব আমার একটা ছড়াকে গান করেছে- শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে, চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে। এটা আমি ছাত্রাবস্থায় বুয়েট থাকতে লিখেছিলাম। কচিকাঁচার মেলায় যখন দাদাভাইয়ের কাছে এটা নিয়ে যাই, দাদাভাই আমার এই কবিতাটা পড়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন। বসা ছিলেন, দাঁড়িয়ে বললেন, একটু আগে যদি তুমি কবিতাটা আনতে তাহলে আমার একটু সুবিধা হতো। একজন আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসে জিজ্ঞেস করেছিলো, ছোটদের কবিতা এবং ছড়ার মধ্যে পার্থক্য কী? তোমারটা কবিতা হয়েছে।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: সৈয়দ হকের ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ নিয়ে আপনার উপলব্ধির কথা আরেকবার বলুন।
আনিসুল হক: ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ অসাধারণ। এটি একটি বড় কবিতা বা কাহিনীকাব্য যা আত্মজৈবনিক। যে ঘোরের কথা তুমি একটু আগে বলছিলে, একজন কিশোর বা তরুণকে যখন কবিতার ঘোরে পায়, তার দিনরাতগুলি কেমন উথালপাথাল হয়। এটার বর্ণনা দেয়া বেশ জটিল। জন্মে জন্মে যেন কবি হয়ে ফিরে আসি এই বাংলায়… এটা তুমি সৈয়দ শামসুল হকের এই কবিতায় পাবে।

দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনার লেখালেখিতে তাঁর প্রভাব ও প্রেরণার বিষয়টি মিশে আছে…
আনিসুল হক: আমি অনিক রেজার পত্রিকার জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম। রংপুর সার্কিট হাউজে, তখন তিনি বলেছিলেন, তরুণ লেখকদের জন্য আমার তিনটি উপদেশ আছে : পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। তিনি বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে কজন বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছে? কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটা পড়েছে? এটা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে। সৈয়দ শামসুল হক ঐ সময় কলাম লিখতেন বিচিত্রায় ‘মার্জিনে মন্তব্য’- সেটার মধ্যে গল্পের কলকব্জা নিয়ে কাজ করেছেন, গল্প কীভাবে লেখা হয়, শব্দের প্রতি কীভাবে যত্ন নিতে হয়, ভাষা ব্যাপারটা কী? ক্রিয়ার কাল, একটা গল্প- পড়লাম, খেলাম, পড়লো, খেলো করে বলা যায়, পড়ে, খায় এভাবে বলা যায়। আবার পড়বে, খাবে এভাবেও বলা যায়। এ বিষয়গুলি সম্পর্কে আমি সৈয়দ হকের কাছে শিখেছি।
[চলবে… সাক্ষাৎকারটি মোট তিনটি পর্বে প্রকাশ হবে। যেখানে আনিসুল হকের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ তারঁ যাবতীয় সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তি জীবনের কথাও উঠে আসবে। আজ সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রকাশ হলো।]

আনিসুল হক– জন্ম ৪ মার্চ ১৯৬৫, রংপুরের নীলফামারীতে। পিতা মরহুম মো: মোফাজ্জল হক, মাতা মোসাম্মৎ আনোয়ারা বেগম। রংপুর পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছাত্রাবস্থা থেকেই সাহিত্য ও সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রকৌশলী হিসেবে একবার যোগ দিয়েছিলেন সরকারি চাকরিতে, কিন্তু ১৫ দিনের মাথায় আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতা তথা লেখালেখিতেই। বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার উপসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আনিসুল হক।
সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার বিচরণ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, কলাম, চিত্রনাট্য, শিশুতোষ রচনাসহ নানা কিছু লিখেছেন। প্রায় ৬০টির মতো বই বেরিয়েছে। তাঁর রচিত নাল পিরান, প্রত্যাবর্তন, করিমন বেওয়া, প্রতি চুনিয়া, মেগাসিরিয়াল ৫১বর্তী প্রভৃতি টেলিভশন নাটক ব্যাপক আলোচিত এবং দর্শকনন্দিত হয়েছে। আনিসুল হকের সেরা সাহিত্য তাঁর উপন্যাস মা। এক মুক্তিযোদ্ধা মাকে নিয়ে লেখা এই উপন্যাস একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

———–
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গল্পকার এবং গল্পপত্র সম্পাদক মাসউদ আহমাদ

ফেসবুক-এ লগিন থাকা অবস্থায় মন্তব্য করুন-

টি মন্তব্য

2 Comments

  • Anisul Haque-key sobai chene. Tar(T-ar uporey chandrabindhu) Boyosho-0 Alpo. Tar Sakkatkar Chapar Arto Telamathay Tel Deya. Bangladesher Aro Anek Sahittyik Lukchokkur Antoraley Porey Achen, Tader Khuj Kew Rakhena.

  • মাসউদ আহমাদ, এই সুন্দর পরিকল্পনা ও উপস্থাপনার জন্য অভিনন্দন। আর নুসরাট টনি, ব্যর্থ কথা বলার মধ্যেও কোনো সাফল্য নেই।

Facebook

Get the Facebook Likebox Slider Pro for WordPress