আমীরুল ইসলাম: ২০১৪-এর ৭ এপ্রিল ছিলো ছড়াকার আমীরুল ইসলামের পঞ্চাশতম জন্মদিন। কৌতুক প্রিয়, আড্ডাবাজ, জীবন-রসিক, ভোজন প্রিয়, পৃথিবী ঘোরা এই ইবনে বতুতার সঙ্গে আড্ডা জমালো আশিক মুস্তাফা। আমীরুল ইসলাম ছড়ার বাইরে পুরনো বই ও চিত্রকলা সংগ্রহ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। দাবা খেলা আর রবীন্দ্র সংগীত পাগলু এই ছড়াকার চ্যানেল আইতে বসে কথাগুলো বলেছেন... চলুন, কী বললেন... এই অন্য আমীরুল ইসলাম; তা পড়ি...

ক’দিন আগে গেলো আপনার পঞ্চাশতম জন্মদিন। এই পঞ্চাশ যখন জন্মদিন আসে তখন অন্যরকম একটা মাত্রা যোগ করে। আর তখন কেন যেনো মনে পড়ে আবু হাসান শাহরিয়ারের সেই ‘বাস/ আস্তে আস্তে যাস।/ মেঘে মেঘে/ বয়স আমার ছুঁয়েছে পঞ্চাশ…’ কবিতাটা। লিখেছিলেন ছড়াকার নাসের মাহমুদ ভাইয়ের পঞ্চাশতম জন্মদিনে। আপনাকে দেখলে মনেই হয় না পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। সেদিন ফেসবুকে আপনার তরুণ বয়সের সাদাকালো কিছু ছবি দেখে মনে হলো আপনি সেই তরুণটিই আছেন। যাক, জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিয়েই বলি, শেষ জন্মদিনটা কীভাবে পালন করলেন?
পঞ্চাশ আসলেই অন্যরকম একটা অনুভূতি। তবে জন্মদিন পালন করে বিখ্যাতরা। আমার মতো অখ্যাত মানুষের আবার জš§দিন কীসের? আমার কিছু মেয়ে ভক্ত আছে। জন্মদিনটা তাদের সঙ্গেই কেটে যায়।
তারা কী আপনার লেখা পড়ে ভক্ত; না-কি অন্য কোনোভাবে?
নানাজন নানাভাবে-কেউ লেখা পড়ে, কেউ ব্যাক্তিগতভাবে, কেউ টেলিভিশনের পর্দার। কেউ আবার পর্দার আড়োলের। পঞ্চাশতম জš§দিনে ফারজানা ব্রাউনিয়া তার ছাদে একটা পার্টি দিয়েছিলো। সেদিন আমার প্রচফ্ফ জ্বর ছিলো। তবু তার অনুরোধে সেখানে গেলাম। ব্রাউনিয়ার সঙ্গে সেদিন গুণদার মেয়ে মৃত্তিকা গুণ, মৌসুমী বড়–য়া, অনন্যা রুমাসহ আরো অনেকে ছিলো। সবার সাহচর্যে জš§দিনটা ভালোই কাটলো। ওরা আমার জ্বরের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো।
এতো নারী আপনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। বিয়ে করলে তো একজন দুঃখ প্রকাশ করতো; এজন্যই কি বিয়ে করেন নি?
আসলে আমাকে কেউ বিয়ে করেনি। যাকে পছন্দ করেছি সেই আমাকে এড়িয়ে গেছে।
কয়জনকে পছন্দ করেছেন?
অনেক পছন্দ করেছি।
পছন্দের তালিকায় কারা ছিলো?
এটা তো গোপনীয়। তবে শ্রদ্ধেয় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও ছিলেন সেই পছন্দের তালিকায়। একদিন আমার বন্ধু শহিদুল আলম সাচ্চু তো দিদিকে বলেই দিয়েছেন যে, দিদি, আমরা দু’জন আপনাকে বিয়ে করতে চাই। তিনি বলেছিলেনÑ যাকে পছন্দ করো; তার মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবে।
তা বন্যাদির ছায়া কারো মাঝে পেয়েছেন?
আর খুঁজিনি (দুষ্টুমি করে বললাম)। তবে অনেক নারীর ভালোবাসা, প্রেম, আবেগ, শ্রদ্ধাবোধ এসব নিয়েই তো একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম।
এই খোঁজাখুঁজি তো লেখালেখিতে আসার পর শুরু হলো। লেখালেখিতে কীভাবে এলেন; সেটা বলুন?
খুব ছোট বেলায় গল্পের বই পড়তাম। তখন হাতের কাছে যা পেতাম তার বেশির ভাগই গল্পের বই। ছড়ার বই তেমন পেতাম না বললেই চলে। ভাবতাম, ছড়া লেখা হয়তো বেশ কষ্টের তাই ছড়ার বই নেই পর্যাপ্ত। এ- থেকেই কষ্টের ছড়া দিয়ে লেখালেখি শুরু করলাম। প্রথম প্রথম ছড়া লিখে কাউকে দেখাতাম না। পরে ১৯৭৭ সালে সপ্তম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় প্রথম ১২ লাইনের একটা ছড়া দৈনিক বাংলার ‘সাতভাই চম্পা’ বিভাগে পাঠাই। তারা চার লাইন কেটে ৮ লাইন ছাপে। এটি প্রকাশের জন্য ১০ টাকা সম্মানীও পাই। এরপর দৈনিক আজাদের ‘মুকুলের মহফিল’-এ হাফপ্যান্ট পরে ছড়া দিয়ে আসতাম স্কুল থেকে ফেরার পথে। তখন বিষয় ভিত্তিক লেখা বেশি ছাপতো। তাই বিষয় ভিত্তিক ছড়া লেখা শুরু করলাম। অনেককে নিয়ে ছড়া লিখেছি। মওলানা আক্রাম খাঁকে নিয়েও লিখেছি। তারপর দশম শ্রেণীতে উঠে ইত্তেফাকে লেখা পাঠানো শুরু করি। এই দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের দেখা পাই। তখন পল্টনে বায়তুল মোকাররম মসজিদে ইসলামী ফাউন্ডেশনে বসতো অনুশীলন সংঘের সাহিত্য আসর। এটি পরিচালনা করতেন শেখ তোফাজ্জল হোসেন। সবাই সে আসরে যেতো। লেখা নিয়ে কথা হতো। পরে রফিকুল হক দাদু ভাইয়ের সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা’য় লেখা শুরু করলাম। এভাবেই শুরু…।
স্কুল শেষে কলেজজীবনে এসে লেখালেখিটা কোন দিকে মোড় নিলো?
আমার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তাই স্কুল শেষে ঢাকার আলোচিত-ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। তুমুল রাজনীতি করতাম। নির্বাচন করলাম কলেজে। সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিতও হয়েছিলাম। কলেজজীবন শেষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলাম। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ ঢাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলাম সাহিত্য সম্পাদক পদে। তবে জিততে পারিনি। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আমান উল্লাহ্ আমান-খায়রুল কবির খোকন প্যাানেলের কাছে হেরে যাই।
পরাজয়ের সঙ্গে কি লেখালেখিটারও বারোটা বাজলো?
আরে না! এর আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের দিকে বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের উৎকর্ষধর্মী পত্রিকা ‘আসন্ন’র সম্পাদক হই।
আমাদের বেইলী রোডের কলোনীতে প্রথম বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ির সঙ্গে পরিচিত হই। গাড়ি থেকে বই নিয়ে পড়তে গেলেই দেখতাম আপনার নাম। মাযহার ভাইয়ের নাম। এই ক্লাসিক্যাল বইগুলোর সম্পাদনায় কীভাবে এলেন?
সবই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কল্যাণে। আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে দিলেন তিনি। তার মতো গুণীজনের সঙ্গে মিশে জীবনটাকে নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি। তার পরামর্শে কেন্দ্রের প্রকাশনাটা আমিই শুরু করি।
দৈনিক পত্রিাকায় কখন কাজ শুরু করলেন?
অই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে থাকা অবস্থায়ই দৈনিক পত্রিকায় আসি। দৈনিক বাংলার প্রথম চার কালার ‘কিশোরদের পাতা’ আমি আর ধ্রুব এষ শুরু করি। দৈনিক বাংলা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ বছর পরিচালনা করি বিভাগটা।
দৈনিক বাংলা বন্ধ হওয়ার পর কই গেলেন?
তখন দৈনিক প্রভাত নামে একটা পত্রিকা বের হতো। পত্রিকাটির ফিচার সম্পাদক হই। সেখান থেকে চ্যানেল আই-এ আসি। এখানে আজ ১৩ বছর। সাগর ভাইয়ের স্নেহ-ভালোবাসায় সব দিয়ে দিলাম। এখন চ্যানেল আই আমার ঘর, আমার বাড়ি, আমার সব…।
চ্যানেল আই তে বসে এবং তারও আগে আপনি অনেক বই লিখেছেন। আপনার বইয়ের নামগুলো একটু অন্য রকম। কারণ কী?
অতি ব্যবহৃত নাম ভালো লাগে না মোটেও। নিজের বইকে একটু আলাদা করার জন্যই এমন নাম বেছে নেওয়া।
বইয়ের নামের মতো আপনার লেখাগুলোও অন্য রকম। প্রচলিত লেখার চেয়ে একটু আলাদা। এদিকে অনেকে আপনার ছড়াকে তো ছড়াই মনে করেন না। থোড়াই কেয়ার করে উড়িয়ে দেন; কেউ কেউ আবার ছড়ার সঙ্গে কিশোর কবিতার ডিবেটে ফেলে ছড়ার খতনা করিয়ে ছাড়েন। এই নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
পুরনো লেখা পড়েছি। তা থেকেই শিখেছি নতুন কিছু করার। মানুষ নতুন কিছু লিখতে পারে না। তবে চেষ্টা করে। আমিও সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। কতটুকু পেরেছি তা জানি না। আর কিশোর কবিতা নিয়ে ডিবেট করে অশিক্ষিতরা। তাদের শিল্পের নন্দন তত্ত্ব পড়া উচিত।
তাদের নন্দন তত্ত্ব পড়ানোর দায়িত্বটা কারা নেবেন?
কাউকে নিতে হবে না। মেয়ে বড় হলে তাকে কেউ উড়না পরিয়ে দেয় না। নিজ থেকেই পরা শিখে নেয়। কেউ চাইলে পড়বে, না চাইলে পড়বে না।
মেয়ে থেকে নারী। তারপর বউ। এই বউটা না থাকায় কী ছড়াসাহিত্যে আপনার এতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
হয়তো তাই। আসলেই আমার বউ নেই। তাই ছড়াকে সময় দেই। বউ নেই তাতে কি? বই তো আছে। ছড়াই বই-ই আমার বউ!
এই বউয়ের খপ্পরে অনেক সময় গেলো। আপনার বউ মানে বইয়ের ভেতর অসংখ্য ছড়া খুঁজে পাই ‘ছড়া’ শিরোনামে। এর কারণ কী?
নাম খুঁজে পাই না, তাই এই নাম দিই। এটা আমার ব্যার্থতা বলতে পারো।
এই ব্যার্থতা স্বীকার করলেও লেখালেখিতে নাকি ক্লান্তি আছেÑ তা স্বীকার করেন আপনি?
না। তবে প্রতিদিনই আমি হতাশ হই এই ভেবেÑ যা লিখতে চেয়েছি, তা লিখতে পারিনি মনে হয়।
হতাশার ডানায় ভর করেই তো আপনি ৮০ টা ছড়ার বই লিখে ফেলেছেন। এই বইগুলোয় কতোগুলো ছড়া আছে?
৬০টা বইয়ে ১০০ করে বা তারও বেশি ছড়া আছে বইগুলোয়। আর ২০টি বইয়ে আছে ২৪ টা করে।
তার মানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ছড়া আছে বইগুলোয়। ছড়া লিখতে এসে মাঝে মধ্যে থমকে যেতে হয়েছে। তখন ফুয়েল হিসেবে কাদের লেখায় গতি পেয়েছেন?
অন্নদা শংকর রায়। আল মাহমুদ। জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, ফয়েজ আহমদ। আর সমকালীন সুকুমার বড়–য়া, লুৎফর রহমান রিটন। এছাড়াও যারা ভালো লেখেন, তাদের লেখা পড়ি। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে আহমেদ সাব্বির, অদ্বৈত মারুত, আদিত্য রুপু, আবিদ আজম, আশিক মুস্তাফার ছড়া ভালো লাগে। তোমার ছড়ার বই ‘একশো ফড়িং একটা আমি’ নিয়ে তো একটা রিভিউ লিখেছি মামুন সারওয়ার সম্পাদিত ‘লাটাই’-এ।
তরুণদের কাছে আপনার চাওয়াটা কী?
অপেক্ষা করছি, তোমারা এবং অনাগত কালের তরুণরা আরও ভালো লিখে আমাদের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবে! তরুণদের কাছে পরাজিত হওয়ার জন্য এখনো নিয়মিত লিখে যাই। আর ভাবি, তরুণরা নতুন করে সাহিত্য করবে। তাদের এই পরিবর্তনটা দেখার জন্যই বসে আছি।
এই বদলের আভাস কি কিছুটা দেখতে পাচ্ছেন?
আসলে সমাজ চেতনা, রাষ্ট্র চেতনা এসবের সঙ্গে সাহিত্যের ট্রাফিকও বদলায়। তাই পরিবতন আসাটাও স্বাভাবিক। তবে যতোটা আশায় আছি, ততটা দেখছি না। তবে এখনকার অনেকের লেখায়ই শক্তি আছে। শক্তি না থাকলে কি পত্রিকায় প্রতিদিন ছড়া ছাপা হতো?
ছড়ার শক্তি আছে ঠিকই। ছড়ার সঙ্গে অন্য লেখা দিয়ে মানুষের ভেতর কীভাবে ঢোকা যায়?
আসলে যে যতো কঠিন কথাকে সহজ করে বলতে পারবে সে লেখাটাই পাঠককে তত বেশি আকৃষ্ট করবে। আর এ গভীর কথাকে সহজ করে বলতে পারাতেই লুকিয়ে থাকে পাণ্ডিত্য।
আপনার সেই পা-িত্য নিশ্চয়ই আছে?
আছে কি না, জানি না। সেটা পাঠক বলবে। পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম। আগামী প্রজš§ই বিচার করবে লেখার পান্ডিত্য।
বলি, পাঠক লেখা পড়েই আপনার পা-িত্য খুঁজে বের করুক। আর আপনি আপনার কাঙ্খিত সেই লেখাটা লেখার চেষ্টা চালিয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠুন। ছড়ার কমরেড, স্যালুট আপনাকে।
লাল সালাম তোমাকেও!