ইস্টিশন

আজমেরী বিবির অবজারভেশন

সেদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার চাঁন-তারা মসজিদের আশপাশে। সোরগোল শুনে পাশে তাকাতেই এক বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি গেলো। সে গভীর মমতায় কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে মেতেছিলো। এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো সে তাদের আঁকাআঁকি শেখাচ্ছে- আঁকছিলো তখন একটা বিড়াল। তার ভাষায়- বিলাই। বসে থাকা বিড়ালের পেছনের পা দুটো সত্যিকারার্থে দেখা না গেলেও সামনের পা দুটো দেখি আমরা অনেকেই। কিন্তু ছবি আঁকার সময় তার ভাবনায় যে বিড়ালটি ধরা দিয়েছিল সেই বিড়ালের হয়তো চারটি পা-ই অদৃশ্য ছিল। আর এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক ভাবনা অস্বাভাবিক হয়ে ধরা দেওয়া পথফুলটির নাম আজমেরী- আজমেরী বিবি।
দিনের শেষে রাতটাও তার পথে ঘাটেই কেটে যায়। কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে। পথের পাশে ফুটে থাকা দুপুরমণি ফুল চিনি আমরা অনেকেই। এই অদ্ভুত সুন্দর ফুলগুলো দুপুরের দিকে ফোটে দিনের আলোয় লুটোপুটি খেয়ে সন্ধ্যার আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অজানায় হারিয়ে যায়। তবে আজমেরী বিবিরা দুপুরমণির মতো চাইলেই হারাতে পারে না। পৃথিবীর আলো-হাওয়া গায়ে মেখে লড়াই করে যেতে হয় তাদের। কীভাবে কাটে তাদের দিন, জীবনযুদ্ধের এমন অজানা অনেক কথা শোনালেন তিনি।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক মুস্তাফা। ছবি সিনথিয়া শারমিন

কী করেন?
কী, হইছে না এইটা?

কী?
বিলাই! এই, এইটা হলো গিয়া মাথা। এই দুইটা চোখ। এইটা প্যাট আর এইটা হলো গিয়া লেন্জা।

হ, হইছে তো। কিন্তু ঠ্যাং কই?
বিলাইটা বইসা আছে তো, এল্লেইকগ্যা ঠ্যাং নাই।

ও-ও, আচ্ছা! আপনার আঁকা বিলাইটা কোথায় বইসা আছে?
রাস্তাটায়। ডাস্টবিনের পাশে।

কিছু খাইতে বসেছে?
হ, খাইতেই তো এমন কইরা বসে বিলাই।

আপনি সকালে খাইছেন?
হ, খাইছি।

কী খেতে ভালো লাগে আপনার?
দোকানের মোরগ পোলাও, তেহারি আর মাইনসের ঘরের হইলে গরম ভাত।

ঠাণ্ডা ভাত খান না?
না, বুকে ঠাণ্ডা লেইগা যায়। বয়স হইছে তো; শরীর সব কিছু মানতো চায় না।

কত হইছে বয়স?
জানি না। যুদ্ধ দেখছি। পাকিগো তাড়া খাইয়া আমরা নদীর ঐ পাড়ে কেরানীগঞ্জ চলে গেছলাম।

পরে?
পরে দেশ স্বাধীন হওনের পর ঢাকায় ফিরা আইছি। আইসা ঘর খুঁইজা পাই নাই। এরপর থাইকাই ঘরছাড়া হইয়া যাই।

আপনার বাবা-মা ছিল না তখন?
না, যুদ্ধের আগেই আমার বিয়া হইয়া গেছিল।

তা আপনার জামাই কোথায়?
সে তো মারা গেছে অনেক আগে।

যুদ্ধের আগেই?
না। যুদ্ধের পরে।

কীভাবে?
নেশা কইরা। হেরোইন, গাঞ্জা এসব খাইয়া দুনিয়া ছাড়ছে।

Interview of Street Begger
ছেলেমেয়ে নেই আপনার?
আছে। এক পোলা এক মাইয়্যা। পোলাটার নাম পানা আর মাইয়্যার নাম পেনী। পোলা একটা দোকানে থাকে আর মাইয়্যাটারে বিয়া দিছি। এই যে মাইয়্যাটা। এইটা আমার মাইয়্যার ঘরের নাতনি। নাম হইলো একা।

আপনার ছেলেমেয়েদের এমন নাম রাখলেন কেন?
(হাতে দাগ কেটে দেখায়) এই এইটুকু থাকতেই মারা যাইত। পরে এমন নাম রাখাতে এই দুইটা বাইচা যায়।

ছেলেমেয়েরা থাকে কই?
পোলা (হাতের আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় দেখায়) অই যে, অই দিকে একটা দোকানে কাজ করে। সে আমারে মারে। আমার সঙ্গে থাকে না। মাইয়্যাটা জামাইর সঙ্গে থাকে। জামাইটা বেশি ভালো না। চোখের নেশা খারাপ। রাস্তা ঘাটে মাইয়্যা মানুষ দেখলেই তার ভালো লাইগা বসে। পরে আমার মাইয়্যারে যা-তা কয়। এই মাইয়্যাটারেও মারে। এল্লেইকগ্যা এরে নিয়া আইছি এক্কেবারে ছোট্ট বেলায়।

সে আপনার সঙ্গে থাকতে চায়?
চায়। এখন হে তো আমারেই মা কয়।

তার মারে কী কয়?
নাম ধইরা কয়। আমি যদি কই, ও একা, তোর মারে ডাক তো। সে কয়, এই পেনী, তোরে মায় ডাকে।

এতে তার মা রাগ করে না?
না। আগে করত। এখন করে না।

একা পড়াশোনা করে না?
করে। সে চারটা এনজিও স্কুলে পড়ে। একটায় তো আপনার মতো ভাই-আপুরা পড়ায়। চকোলেট খেতে দেয়। এইজন্য সে চারটা স্কুলেই যায়। তয় আমি কইছি, এতগুলোয় না গিয়ে ধ্যান-জ্ঞান দিয়া একটাতেই পড়। সে কথা শোনে না। সারা দিন এই স্কুল, অই স্কুল কইরা বেড়ায়।

কী পড়ে স্কুলে?
কত কী পড়ে। এই পেন্সিল খাতা আর রাবারটা আমি কিইন্যা দিছি। ও একা, তোর নামটা লেইখা দেখাত।
(পেন্সিল ধরে না মেয়েটা। পাশে একটা পুরনো মাম পানির বোতল। সেই বোতলের ডাকনায় পানি ঢেলে মেয়েটা তাতে আঙুলের মাথা চুবিয়ে নান রুটির চুলোর ওপরে আঙুল ঘুরিয়ে উল্টো করে লেখে- একা। আজমেরী বিবি মেয়েটার মাথায় রাজ্যের মায়া নিয়ে হাত বোলাতে থাকে।)

Street Begger Interview
নাতনিটাকে তার মায়ের কাছে দেবেন না, সে তো বড় হয়ে উঠছে?
দিমু। তয় তার আগে তারে সোনার দুল বানাইয়া দিমু এক জোড়া।

এত টাকা পাবেন কই?
(সে তার পোঁটলা থেকে একটার পর একটা, এমন পাঁচ-ছয়টা ব্যাগের ভেতর থেকে তিনটা পলিব্যাগ বের করে। তার একটায় এক-দুই আর পাঁচ টাকার কয়েন। আরেকটায় দুই টাকার নোট এবং অন্যটায় একশত টাকার নোট। টাকাগুলো দেখিয়ে বলে।) বারশ’ টাকা আছে এখানে। আরও জমিয়ে তাকে সোনার দুল বানাইয়া দিমু। তারপর মইরা যামু। তয় আমার মাইয়্যারে কইছি, মরার পর আমার পোলারে জানাবি না। টাকাটুকা তুইল্যা আমারে আজিমপুর কবরস্তানে রাইখ্যা আসবি।

(এই বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠে তার। স্বাভাবিক থাকতে পারি না আমিও। একজন ছেলে হয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তখন। আহ্, কেন বুঝি না আমরা মায়েদের? আর কত তাদের চোখের পানি ঝরিয়ে উৎসাহে মাতব? কত গুরুত্বহীন করে রাখব এমন পথফুলদের অবজারবেশনগুলো? তারা কী কখনোই গুরুত্ব পাবে না আমাদের কাছে?)

ফেসবুক-এ লগিন থাকা অবস্থায় মন্তব্য করুন-

টি মন্তব্য

Facebook

Get the Facebook Likebox Slider Pro for WordPress