সাহিত্যিক

মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই – হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ এবং মাসউদ আহমাদ

হুমায়ূন আহমেদ এবং মাসউদ আহমাদ

ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার লক্ষ্যে আপনি দীর্ঘদিন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে আছেন; অল্প কিছুদিনের জন্য দেশে এলেন এবং বিমানবন্দরে নেমেই, ধানমন্ডির দখিন হাওয়ার বাসায় না গিয়ে সরাসরি নুহাশ পল্লীতে চলে এলেন। কেমন লাগছে?

তোমরা একসঙ্গে এত সাংবাদিক এবং শুভাকাক্ষি এসেছ, আমার খুব ভালো লাগছে। আর দীর্ঘ জার্নি করে আসছি তো, মাঝখানে বিমান লেট ছিল, শরীরটা যে খুব ভালো তাও না। এসেই ধাতস্থ হতে কিছুটা গুছিয়ে নিতে হয়, সেটা এখনো হয়নি। তবু আমার খুবই ভালো লাগছে। বন্ধুবান্ধবের অনেককে খুব মিস করছিলাম, ওদের সবাইকে পাচ্ছি, আত্মীয়স্বজন অনেকে এসেছেন। ভালো লাগছে। আর নুহাশ পল্লীর গাছপালাকে মিস করছিলাম খুব। ওরা আমার সন্তানের মতো। গাছপালার কাছে ফিরে এসে খুবই আনন্দ পাচ্ছি।

আপনার মা, তাকে আপনি অনেক ভালোবাসেন; একটু আগে তিনিও বলছিলেন- আপনাকে কাছে পেয়ে তিনি খুবই আনন্দিত, তার প্রতীক্ষা আনন্দে রূপ পেয়েছে। মায়ের কাছে ফিরে এসে আপনার অনুভূতি কী?

তোমরা যেমন নাকি কান্নার মতো জিনিস আশা কর, সেটা আমার মধ্যে নাই আসলে। মাকে দেখেছি, ব্যাস, ফুরায় গেল। হাউমাউ করে কান্না, জড়ায় ধরা- এসব আমার মধ্যে আগেও ছিল না, এখনো নাই।

স্যার, অল্প কিছুদিন পরে আপনি আবারও আমেরিকায় চলে যাবেন। এখন আপনি অনেকটা সুস্থ। এ মুহূর্তে আপনার কেমন বোধ হচ্ছে? আপনার ভক্তরা অপেক্ষায় আছে, আপনি কেমন আছেন তা আপনার মুখ থেকে শোনার জন্য…

আমাকে দেখে তোমাদের কেমন লাগছে বলো। ভালো? ভালো লাগছে, তাইনা? আমি আমেরিকায় ভালোই ছিলাম। আমি এ সমস্ত রোগ-ব্যাধি-অসুখকে জীবনে কোনোদিনই পাত্তা দেইনি। এখনো দিচ্ছি না। যেটা হওয়ার, হবেই। এটা নিয়ে হা-হুতাশ করে দুনিয়া মাতানোর তো কিছু নাই, আমি কিছু মাতাচ্ছি না। আমার ধারণা, আমি ভালোই আছি। আবার আমেরিকায় ফেরত যাব। ওখানে আমার একটা অপারেশন হবে। বিষয়টা একটু গুছিয়ে বলি। জিনিসটা হচ্ছে তোমার ক্যান্সারটা হয়েছিল কোলনে, বৃহদান্ত্রে। ক্যান্সার হওয়া খুব কমন একটা ব্যাপার। কমন ব্যাপারটা এ কারণে, আমেরিকা বা পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশে ক্যান্সার হলে প্রবলেমই মনে করে না। ওটা কেটে ফেলে দেয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে এ বিষয়টি নেই। কাজেই জীবনে পলি ব্যাপারটা নাই। পলি হল, সেটা বড় হল, পরে সেটা ক্যান্সারে রূপ নেয় এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি হয়। আমারটা ঠিক তেমনি, পলি থেকে ক্যান্সার হয়ে গেল, আমি টের পেলাম না। সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেখানে একটা চেকআপে ক্যান্সারটা ধরা পড়ল। চলে গেলাম আমেরিকায়। সিঙ্গাপুরে ট্রিটমেন্ট করলাম না এ কারণে যে, আমাদের অনেক প্রিয়জন সিঙ্গাপুরে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট করতে গিয়ে মারা গেছে। আমার নিজের এত সিরিয়াসনেস ছিল। বন্ধুদের জোরাজুরিতে চিকিৎসাটা করাতে হল। এখন চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেখা গেল- আমার ক্যান্সারটা ফোর্থ স্টেজ। এর আগের স্টেজগুলো পার করে আসছি এবং ফোর্থ স্টেজ কিন্তু ভয়াবহ স্টেজ। বাই দিস টাইম, বৃহদান্ত্র থেকে ক্যান্সারটা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে গেছে। ডাক্তাররা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল আগে। তারা চেষ্টা করল এবং খুব একটা যে সাকসেসফুল হল তা না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ডাক্তার মোটামুটি হতাশ হয়েই বলল, এ মুহূর্তে বিশেষ কিছু বলতে পারছি না। তোমার তো মনে হয় বাকি জীবনটা কেমোথেরাপি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে যদি বাঁচি আমি কতদিন বাঁচতে পারব? ডাক্তার বলল, দুই বছর বাঁচতে পারবা। এটা যে কোনো মানুষের কাছেই একটা কঠিন ধাক্কার মতো। যখন তুমি জানবে তোমার আয়ু আছে আর মাত্র দু’বছর। তাই না? এই ধাক্কাটা শোনার পর মনটা খুব খারাপ হল। বাই দিস টাইম, তারা আমাকে রেফার করল সার্জিক্যাল অনকোলজিতে, সার্জনের কাছে। সেখানে সার্জনরা আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে বলল, এই লোকের তো আর কিছু করা যাবে না। পরে তারা তারিখ দিল ১২ জুন। তারা এ তারিখে একটা মেজর অপারেশন করবে আমি ডাক্তারকে বললাম, অপারেশন করলে আমি তো মারা যেতে পারি, তাহলে এই সময়ের মধ্যে আমি আমার দেশ, বন্ধুবান্ধব, মা, আমার গাছপালাকে দেখে আসতে পারি? ডাক্তার বলল, অবশ্যই পার। এ সূত্রেই বাংলাদেশে আসা। তারপর আমেরিকায় ফিরেই আমি মরে যাব, তা কিন্তু না।

অপারেশন নিয়ে ডাক্তাররা আর কিছু বললেন?

হ্যাঁ, আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার মরার সম্ভাবনা কতটুকু? ডাক্তার আমাকে বললেন, তার নাম হচ্ছে জর্জ নীলা। তিনি কখনো রোগীর দিকে তাকান না, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। তিনি বললেন, তোমার অপারেশনটা যদি আমি করি তাহলে তোমার মরার সম্ভাবনা হচ্ছে শূন্য। জিরো পার্সেন্ট। এই সম্ভাবনা তো সংক্রমণের মতো। তবু দেশে এসে গাছপালা, মানুষ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের আদর পাচ্ছি এবং সর্বোপরি আমার মা তো আছেনই।

আমেরিকায় গিয়ে কোন জিনিসটা আপনি বেশি মিস করেছেন?

তোমাদের একটা গল্প বলি। সত্যি গল্প। আমেরিকায় যাওয়ার পর, আমার মায়ের সারাজীবনের সঞ্চয় ডলার করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন হঠাৎ করে। তার সমস্ত সঞ্চয় হয়েছে পাঁচ হাজার পাঁচশ ডলার। এই টাকার বেশিরভাগই কিন্তু আমার পাঠানো। আমি মাসে মাসে অ্যালাউন্স দেই তাকে, সেটা জমিয়ে ব্যাংকে রাখে। এভাবে তার এই টাকাগুলো হয়েছে। আমাকে সবগুলোই পাঠিয়ে দিয়েছে। এ ডলারগুলো পেয়ে প্রথমে একটু রাগ উঠল মায়ের প্রতি। তার নিজের কাছে কোনো টাকা-পয়সা না রেখে সবটা পাঠিয়ে দিল? তারপর মনে হল, ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে যাওয়া উচিত এবং আমার জন্য এটা খুবই জরুরি। কাজেই চলে এলাম। ৮০ বছর বয়স আমাদের দেশ হিসেবে অনেক বয়স কিন্তু। আমেরিকার হিসাবে আবার এটা কোনো বয়স না। ওখানে ৮০ বছরের বুড়াবুড়ি সমানে গাড়ি চালাচ্ছে, কাজ করছে, দৌড়াচ্ছে, বারে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছে। আর আমাদের দেশে ৬০ বছর পার হলেই জায়নামাজ নিয়ে বসে পড়ি। আল্লাহ আল্লাহ করি। কখন মারা যাব তার ঠিক নাই।

স্যার, আপনার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কোনো লেখায় একবার বলেছিলেন বাংলাদেশে একটা বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলবেন। এটা একটা স্বপ্নের কথা হিসেবেই বিবেচনা করব?

বিপদে ফেললে। আমি এই কথাটা আমার লেখায়- নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদে-এ খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, তা না। ঝোঁকের মাথায় মনে এসেছে লিখে ফেলেছি। পরে ভেবে দেখলাম, এটা মহাবিপজ্জনক। আমেরিকা বা পৃথিবীজুড়ে যারা আছেন, তারা ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন আমার উপরে- এই ক্যান্সার ইনস্টিটিউট কখন হবে এবং কীভাবে হবে? অনকোলজি ডাক্তাররা বললেন, আমরা আপনার এখানে অপারেশন করে দেব। কাজ করব। এমনকি নার্সরাও বলল, আমরা বাংলাদেশে গিয়ে কাজ করতে চাই। এ বিষয়ে তারা খুবই আগ্রহ দেখাল। টাকা-পয়সা দিয়ে অনেকে এগিয়ে এল এবং কী পরিমাণে যে সাড়া পেলাম- আনবিলিয়েভল। আমি যেহেতু কথা দিয়েছি, কতটুকু পারি বা না পারি, সেটা পরের ব্যাপার, শুরু তো করতে হবে। একটা বিখ্যাত লাইন আছে না কনফুসিয়াসের- Journey of thousand mile start with… প্রত্যেকটি কাজই এক হাজার মাইলের দীর্ঘ যাত্রা। আমাকে শুরু করতে হবে। আমি না পারি, নুহাশ করবে; তাকে হয়ত কেউ সাহায্য করবে।

স্যার, এই যে দীর্ঘদিন আপনি চিকিৎসা গ্রহণ করছেন, এই সময়ে আপনার লেখালেখি বা অন্য কোনো কাজ কি করা গেছে?

কেমোথেরাপিতে যেটা হয়- অ্যাজানো প্লাটিনাম বলে এক ধরনের পদার্থ শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এটা অত্যন্ত পাশ্বপ্রতিক্রিয়াশীল। সেটার কাজ হচ্ছে হাত-পা অবশ করে দেয়। আমাকে ডাক্তার বললেন, তুমি তো লেখক মানুষ। তোমাকে এটা দিতেই হবে। তোমার হাত যদি অবশ হয়ে যায়, তুমি তো লেখালেখি করতে পারবে না। তুমি একটা কাজ করতে পার, অ্যাজানো প্লাটিনাম নেওয়ার সময় তুমি বলে দেবে আরেকজন কপি করবে তোমার দেওয়া ডিকটেশন অনুযায়ী; কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত, আমি নিজেই, হাত দিয়ে লিখতে পারছি এখন পর্যন্ত। আমি জোর করেই এটা করেছি। কারণ ওই সমস্যাটা এখনও আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। হয়ত কম লিখতে পারছি। কিন্তু লিখতে পারছি। এখন এই নানা রকম ব্যাপার এবং নিয়ম ডাক্তার আমাকে বলে দিয়েছেন। সেসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি ভাবছি, এগুলো সারভাইভ করতে পারব কি না। তোমাদের একটা ঘটনা বলি। ডাক্তারের এসব কঠোর কঠিন নিয়ম দেখে আমার পুত্র নিষাদ আমাকে বলল, বাবা, চল আমরা বাংলাদেশে পালিয়ে যাই। বাংলাদেশে চলে গেলে তো তারা তোমাকে আর খুঁজে পাবে না। সেটা তো আর সম্ভব না। পুত্রের জন্য গভীর মায়া লাগলো আমার।

ক্যান্সার নিয়ে আপনার নিজের কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলবেন, যেটি আমার জানা থাকা দরকার?

আমি ক্যান্সার নিয়ে এত কথা যে বললাম, এর কারণ হচ্ছে যাতে ক্যান্সার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ে। আমাদের দেশে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা একদমই নেই। যখন মেয়েদের ব্রেস্টে ক্যান্সার হয়, ওরা লুকায়ে রাখে কাউকে বলে না এবং আত্মীয়স্বজনের কেউ যেন জানতে না পারে আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে। এ ব্যাপারে মানুষের সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। যাতে চিকিৎসা করাটা সুবিধাজনক হয়। হয়ত বাংলাদেশে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে এবং অনেক রোগী বাংলাদেশের চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে। কাজেই আমাদের সচেতন হতে হবে।

বাঙালি লেখকমাত্রই কবিতার হাত ধরে সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটে। আপনিও প্রথম প্রথম কবিতা লিখেছেন এবং ছোটবোনের নামে পত্রিকায় পাঠালে ছাপাও হয়, তা জানি; প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে লেখা হলো কীভাবে? সেই গল্পটি বলুন…

এক হিসেবে তোমার কথা ঠিক। আমি দৈনিক পাকিস্তানে প্রথম কবিতা লিখে পাঠাই, ছোটবোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে-

দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ,
একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।

এভাবে বেশকিছু কবিতা লিখি। আমার বাবার বই পড়ার খুব শখ ছিল। বাড়ি ভর্তি ছিল বইয়ে। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, দীপ নেভা যার ঘরে নামে। তাঁর লেখা কলকাতার কিছু পত্রিকায়, বাংলাদেশের আল ইসলাহ, দৈনিক আজাদে ছাপা হতো। লেখালেখি করে তিনি কলকাতার কোনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে সাহিত্য সুধাকর উপাধিও পেয়েছেন। আমি তো প্রথমে লিখলাম শঙ্খনীল কারাগার। যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে এটি প্রথম লেখা হয়েছিল। নন্দিত নরকে উপন্যাসের হাতে লেখা পান্ডুলিপি আমার বাবা পড়েছিলেন। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁর মুগ্ধতা টের পেয়েছিলাম কয়েকদিন পরেই। তাঁর লেখা রেডিও নাটক কত তারা আকাশে; এর পান্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুই তোর মতো ঠিকঠাক করে দে।

তার মানে পারিবারিক একটা আবহ ছিল সাহিত্যের অনুকূল নিকুঞ্জে?

হ্যাঁ, তা ছিল। আমার বাবাই ছিলেন এর প্রধান, সেনাপতির ভূমিকায়। তুমি লক্ষ্য করলে দেখবে, আমাদের ভাইবোনদের প্রত্যেকেই খুব গল্পবাজ। আমার মাও গল্প করতে খুবই পছন্দ করেন। বাবাও গল্পগুজব করতে খুব পছন্দ করতেন। ব্যাপারটা হয়ত জিনের মাধ্যমে এসেছে। জেনেটিক্যালি।

হুমায়ূন, তোর এই লেখাটা কিচ্ছু হয় নাই, কী ছাইপাশ লিখেছিস? দীর্ঘ লেখক জীবনে এমন কাঠিন্যময় মন্তব্য কখনো শুনতে হয়েছে?

বহুবার শুনতে হয়েছে। এখন কি রেহায় পেয়েছি। আমার সমালোচকরা আমার কোনো লেখাকে লেখা হিসেবেই গণ্য করে না। আমাকে লেখকের পর্যায়েই তারা রাখতে চায় না। ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি আমার মতো লিখেছি। তোমাকে বরং একটা মজার ঘটনা বলি। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আহ্বান করা হয়। আমি গল্প, কবিতা প্রবন্ধ এমনকি ভ্রমণকাহিনী সবই জমা দিলাম। সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রতিটি রচনাই পড়েছেন। বললেন কী লিখেছিস? সবই তো অখাদ্য। যাই হোক, তোর যখন এত আগ্রহ, তুই বরং ইংরেজিতে যা ইচ্ছে লিখে নিয়ে আয়, ছেপে দেব। ইংরেজি সেকশনে কোনো লেখা জমা পড়েনি। আমি লিখে ফেললাম একখানা কবিতা। ঈশ্বরবিষয়ক অতি উচ্চশ্রেণীর ভাব বিষয়ক ইংরেজি কবিতা। পরে সেটি ছাপা হয়। আমাদের কাসের ইংরেজির শিক্ষক একদিন ক্লাসে এসে আমার কবিতাটি পড়ে শোনালেন। তিনি খুব মুগ্ধ আমার কাব্য প্রতিভায়। স্যার বললেন- হুমায়ূন, তুই ইংরেজি কবিতা লেখার চর্চাটা ছাড়বি না।

কবিতাটি কী ছিল?

কবিতার প্রথম ক’লাইন এখনও মনে আছে-

Let the earth move
Let the sun shine
Let them to prove
All are in a lie.

যেকোনো সৃজনশীল লেখক মানুষ ও প্রকৃতিকে নানাভাবে দেখেন, অনুভব করেন; আপনি কবে থেকে এই পর্যবেক্ষণে নিমগ্ন হলেন?

সৃজনশীল মানুষ প্রকৃতিকে অন্যরকমভাবে দেখে, তাইতো? শোনো, প্রতিটি মানুষই- প্রতিটি হিউম্যান বিং সৃজনশীল। তুমি সৃজনশীল হিসেবে আমাকে আলাদা করতে চাও কেন? তুমিও তো সৃজনশীল। অনেকে করে কী- হয়ত লিখছে না, তুমি লিখছো না, ছবি আঁকছো না, তার মানে কি সে সৃজনশীল না? এটাতো হতে পারে না। ইচ এন্ড এভরি পারসন- প্রতিটি মানুষই সৃজনশীল। কেউ লেখে, কেউ আঁকে, কেউ ছবি তোলে, কেউ ছবি তোলে না। যেমন নাসির আলি মামুন, দুনিয়ার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। আমরা তাকে সৃজনশীল মানুষই বলব। তুমিও তো সৃজনশীল। কারোটা প্রকাশ হচ্ছে কারোটা হচ্ছে না। কাজেই আমার মতে, প্রতিটি মানুষই অসম্ভব সৃজনশীল।

লেখালেখি তো একজাতীয় ক্লান্তিকর কাজ। বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক লেখক হিসেবে গণ্য আপনি, এ কাজটি করে চলেছেন প্রায় ৪১ বছর ধরে। এই যে বিরল এবং বিস্ময়কর মানসিক জোর- এর উৎস কোথায়?

এটা মোটেই ক্লান্তিকর কাজ না। ক্লান্তিকর কাজ হলে এটা এভাবে করা যায় না। এটা আমার কাছে আনন্দের কাজ বলেই ৪১ বছর ধরে লেখালেখি করে যেতে পারছি। লেখাটা সবসময়ই আমার কাছে আনন্দময়। বুঝতে পারছো? আনন্দ পাচ্ছি বলেই লিখছি।

আপনার সর্ম্পকে বলা হয়- হুমায়ূন মধ্যবিত্তের জীবনকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মতোন; কেমন লাগে শুনতে?

আমি নিজে মধ্যবিত্তের একটা প্রডাক্ট তো। আমার জন্মই হয়েছে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে। কাজেই আমি হুমায়ূন আহমেদ যদি আমার ফ্যামিলিকে না চিনি, চিনব কাকে? সেইদিকে থেকে এটা বলাই যায়।

আপনার যেকোনো গল্প-উপন্যাসে চরিত্র নির্মাণে আপনি যতটা আগ্রহী, আখ্যানের ডিটেলিংয়ের ততটা নন। কেন?

এটা কোথায় পেয়েছ জানি না। এমন কথা আমি প্রথম শুনছি তোমার কাছ থেকে।

লেখালেখির মাঝেই আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন, এবার আঁকিয়ে হিসেবেও নাম লেখাচ্ছেন আনুষ্ঠানিকভাবে। জুন মাসে, নিউইর্য়কে আপনার আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হচ্ছে। এ সর্ম্পকে কিছু বলুন…

মূলত প্রকৃতি নিয়ে ছবিগুলো এঁকেছি। আমি অ্যাবস্ট্রাক্ট লেভেলে যাইনি- একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিলাম। একটা বিশাল কিছু হয়ে গেল; আমি এরমধ্যে নাই। প্রকৃতি নিয়ে কিছু কাজ করছি। সমস্ত ছবি একসাথে করে একটা প্রদশনী হচ্ছে আর কি।

আপানি তো প্রচুর পড়াশোনা করেন, নিজের লেখালেখির চেয়েও। ইদানিং কী ধরনের বই পড়ছেন?

এই মুহূর্তে নানা ধরনের বই পড়ছি। তবে বিশেষ করে পড়ছি পলেটিক্যাল আইথিক্স। আমি তো দেয়াল নামে একটা উপন্যাস লিখছি, এটার জন্য প্রচুর পড়াশোনার দরকার হয়। যেখানে যা বই পাচ্ছি, পড়ছি। এই মুহূর্তে চলছে আমার কষ্টকর পড়াশোনা। আনন্দময় পড়াশোনা না।

স্যার, দেয়াল উপন্যাস সম্পর্কে লক্ষ্য করলাম, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলছে এবং আজ অনেক সাংবাদিক এ বিষয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কিছু বলতে ইচ্ছুক নন। তবু আমার একটা অনুরাগের কথা বলি- অন্যদিন পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর আমার প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট ছিল হুমায়ুন আহমেদ একটি উপন্যাস লিখবেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা অবলম্বনে; সেই সময়ের পত্রপত্রিকা কী বলছে? সেসব নোট করতে হবে। আপনি পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো নোটটা এ টু জেড করো নাই। তোমার চাকরি চলে যাবে এজন্য নাকি? হা হা…

হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের নিকুঞ্জে অবগাহন করলে পাঠকের কোন প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে?

সে পড়ার আনন্দ পাবে, এটা বলতে পারি। আমার লেখা পড়ে সে বিশাল জ্ঞানী হয়ে যাবে বা বোধ তৈরি হবে, তা আমি মনে করি না।

আপনার অনেক উপন্যাসের নামকরণে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার অংশবিশেষ ব্যবহার করতে দেখি। এটা কেন?

ছোটবেলায় আমার বাবা কবিতা মুখস্ত বলতে পারলে পয়সা দিতেন। প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ছোট কবিতার জন্য একআনা। দীর্ঘ কবিতার জন্য দুই আনা। বাবার কাছ থেকে এই পয়সা পাওয়ার জন্যেই আমরা ঐ সময় কবিতা মুখস্ত করতাম। কবিতার প্রতি মমত্ববোধের পেছনে অর্থনীতি কাজ করেছে। ভালোবাসা নয়। একটা জিনিস যখন শুরু হয় তখন তা চলতেই থাকে। আমার স্মৃতিশক্তি আগে ভালো ছিল। একটা কবিতা দুই তিনবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যেত। কবিতা যদি মুখস্থ থাকে আর আড্ডার মধ্যে যদি একটা দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করা যায় সবাই চমকায়। চমকটা আমার ভালো লাগে। প্রেম করেছি বেশ করেছি এরচেয়ে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনান্দ দাশের কবিতা অনেক সুন্দর।

আমাদের জীবনে মৃত্যু তো অনিবার্য। এই মৃত্যু নিয়ে আপনার বিবেচনা কী?

মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। মরে গেলাম ফুরায় গেল। তবে এটা আমার কাছে খুব পেইনফুল। একটা মানুষ এত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ৭০ বা ৮০ বছর বাঁচে। তারপর শেষ। আর একটা কচ্ছপ সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে। হোয়াই? কচ্ছপের মত একটা প্রাণির এতবছর বাঁচার প্রয়োজন কী?

আপনার মেঘের উপর বাড়ি উপন্যাসে মৃত্যু নিয়ে নানারকম ফ্যান্টাসি লক্ষ্য করি…

মেঘের উপর বাড়ি লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়। মৃত্যুর পরবর্তী জগৎ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, সেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না তাহলে ধর্মেবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে।

বাংলা ভাষায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই সম্ভবত প্রথম, মৃত্যু নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। আপনি তো সর্বভূক পাঠক, তাঁর দেবযান বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন…

হ্যাঁ, আমাদের এখানে তিনিই প্রথম মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগত নিয়ে অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, আমি মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। এটা সত্য। মৃত্যুর পরের জগত নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি। সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটির অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

মৃত্যুর পরে যে অনন্ত জগৎ- সেটা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : অনন্তকালের জগৎ সম্পর্কে তোমাকে কে বলল? একটা পিপড়াকে তুমি পা দিয়ে পিশে মেরে ফেলো; তার কোনো অনন্ত জীবন আছে? মরে গেলে মাটির সাথে মিশে যাব, ফুরায় যাবে।

স্যার, ধর্মে পেয়েছি; আমাকে কেউ বলেনি। পিঁপড়ার কথা জানি না, কিন্তু মানুষের কথা বলা হয়েছে…

মানুষের মতো পিঁপড়ারও কিন্তু প্রাণ আছে, সমাজ ব্যবস্থা আছে, সোলজার আছে। মানুষ আর পিঁপড়ার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?

মানুষের বুদ্ধি বিবেক আছে, পিঁপড়ার নেই-

হুমায়ূন আহমেদ : কে বলেছে নেই? তাদেরও বুদ্ধি আছে। তাদেরও সমাজ ব্যবস্থা আছে। তারাও সুন্দর সুন্দর বাড়ি বানাতে পারে। চাষবাস করে এবং খাওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য সঞ্চয় করে। ওই পিঁপড়াকে যদি আমি পায়ের তলায় পিষে ফেলি, তাহলে তার দফা রফা শেষ। মানুষও এমন। আমাকে এভাবে বলো না। অনেক ধর্মীয় লোকজন আছেন যারা মনে কষ্ট পাবেন। আমি মনে করি না আমার অনন্ত জীবন আছে। আমি মনে করি, যখন আমি মারা যাব তখন মাটিতে মিশে যাব।

———-
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ গল্পকার মাসউদ আহমাদ

ফেসবুক-এ লগিন থাকা অবস্থায় মন্তব্য করুন-

টি মন্তব্য

3 Comments

  • কামরুল হাসান কথিত বিশ্ববেহায়া এরশাদের পর হুমায়ূন আহমেদকেই দেখি জালেম দুনিয়ার পথে নানা পিচ্ছিল জায়গায় ইসলামের তক্তা পেতে হেঁটে পার হতে। ওদিকে কাগজে লেখেন, তাঁর প্রিয় পানীয় মার্গারিটা [১]। মার্গারিটা সম্পর্কে ইসলামের কী বিধান?

  • দিপ বলেছেন: ব্লগার মাষ্টারের কমেন্ট ব্যান, উনি আমাকে ফেসবুকে দারাশিকোকে এই প্রশ্নগুলো করতে বলেছেন। মাষ্টার বলেছেনঃ ১… দারাশিকোর নাম কি পারসিয়ান শাহাজাদা দারাশিকোর নামানুসারে?? ২… বাংলা সিনেমা কেমন দেখতে চান? অন্যান্য দেশের সিনেমা গুলার মতো নাকি স্বতন্ত্র? এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার কেমন করা উচিত বলে মনে করেন? ৩… আপনি পরিচালনায় আগ্রহী জেনে খুশি হলাম। আপনার অনেক বিষয়ে জ্ঞান আছে যা আমাদের অনেকেরি নেই। আমি নিজেও আপনার ব্লগের স্টেডিক্যাম এর লেখাটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু, আপনি কি বেশী সময় নিচ্ছেন না পরিচালনায় নামার ক্ষেত্রে? প্রথম কাজ কখনো নিখুঁত হয়না। একটা কাজ করলে আপনি নিশ্চই আপনার খুঁত গুলো আরো ভালো ভাবে ধরতে পারতেন। সেজন্য কি আপনার ধামাধাম একটি শর্ট ফিল্ম বানিয়ে ফেলা উচিত না?

  • আপনি পোস্ট মন দিয়ে পড়েন না, এটা আমি আগেও খেয়াল করেছি। কেন আমি মৌলি-স্মিতা-অনন্যের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছি, সেটা পোস্টে স্পষ্ট। হুমায়ূন আহমেদ নিজের সন্তানদের আর পাঠকদের নিয়ে অনেক টিয়ারজ্যাকার ঘরানার লেখা লিখছেন, তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছি, তাঁর সন্তানদের মতোই হুমায়ুন আজাদেরও তিনজন সন্তান আছেন, যারা (হয়তো) তাঁরও পাঠক। তাঁদের পিতার ওপর আক্রমণকে হুমায়ূন আহমেদ সমর্থন করেছেন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে। অ্যাপোলজি তাদের প্রাপ‌্য, কারণ হুমায়ুন আজাদ তো ক্ষমা পাওয়ার অবস্থায় নেই। তিনি মৃত। বুঝতে পেরেছেন? নাকি আবার বুঝিয়ে বলতে হবে?

Facebook

Get the Facebook Likebox Slider Pro for WordPress